ইষ্টমন্ত্র

Baba's Name
শ্রী শ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী

হনুমান ছিল খুব বড় ভক্ত৷ একবার হনুমানকে লোকে জিজ্ঞেস করল, দেখ হনুমান, তুমি তো শুধু ‘রাম–রাম’ করতে থাক– কিন্তু ‘রাম’ আর ‘নারায়ণ’ দু’য়ের মানেই তো বিষ্ণু– দুই–ই এক জিনিস, তা সত্ত্বেও ভুলেও তোমার মুখে ‘নারায়ণ’ নাম একবারও শোণা যায় না৷ শুধু ‘রাম’ই শোণা যায়৷ হনুমান বলল, ‘দেখ ভাই, একথা আমিও জানি যে ‘রাম’ আর ‘নারায়ণ’ দুই–ই এক৷’ যেমন ধর, তোমার নাম ‘কমলা দেবী’, কিন্তু ছোট ছোট শিশুরা তো তোমাকে ‘কমলা দেবী’ বলে ডাকবে না৷ কেউ ‘মা’ বলবে, কেউ ‘দিদি’ বলবে, আবার কেউ অন্য কিছু বলবে৷ তাই তোমারও তো অনেক নাম হয়ে গেল৷ ঠিক তেমনি একই পরমাত্মার কখনও ‘রাম’, কখনও ‘নারায়ণ’, এমন অনেক নাম হয়ে গেছে৷ তোমার নাম মনে কর নিরঞ্জন, কিন্তু তোমার ছেলেরা বলবে, ‘পিতা’, ‘বাবু’, ‘ববুয়া’  যাকে তুমি পড়াও সে বলবে, ‘উস্তাদজী’৷ আর যদি তুমি ছাতা মাথায় সড়ক দিয়ে যাচ্ছ আর পেছন থেকে ঠেলা আসছে, তাহলে ঠেলাবালা বলবে, ‘ও ছাতা, ও ছাতা, রাস্তা থেকে সরে যাও’৷ ঠিক তেমনি এক পরমাত্মার অনেক নাম৷ তাই হনুমানের উত্তর ছিল, ‘নারায়ণ’ আর ‘জানকীনাথ’ (জানকীনাথ অর্থাৎ রাম– জানকীর পতি), আধ্যাত্মিক দৃষ্টিতে দু’জনে একই৷ ‘তথাপি মম সর্বস্বঃ শ্রীরামঃ কমললোচনঃ’৷ কিন্তু আমার কাছে ‘রাম’ই সবকিছু৷ ‘নারায়ণ’ কোনো কিছু নয়৷

সেইজন্যে সব মানুষের ইষ্টমন্ত্রই সব কিছু, অন্য কোনো কিছু নয়৷ তার কাছে কেবল একটাই শব্দ সর্বস্ব, আর তা হ’ল ইষ্টমন্ত্র৷ জান তো, কোনো জিনিস খুব বেশী প্রিয় হলে লোকে বলে, ‘একে ঠিকভাবে সামলে রাখো, ছুঁয়ো না’৷ একটা ছোট গাছকে বাঁচানোর জন্যে তাকে ঘিরে রাখতে হয়, ঢেকে রাখতে হয়৷ এইজন্যে রাখি কারণ এটা আমাদের কাছে খুব প্রিয়৷ মানুষের কাছে যেটা খুব প্রিয় বস্তু, তাকে মনের বাইরে রাখা চলবে না, মনের ভিতরে রাখতে হবে৷ খুবই গোপনীয় জিনিস বলে মনের ভিতরে রাখতে হবে৷

ভক্তরা ভগবানের অনেক নাম তৈরী করে নিয়েছে, নিজেদের পছন্দমত অনেক শব্দ তৈরী করে নিয়েছে৷ কিন্তু ইষ্টমন্ত্র এক–ই, অনেক নয়৷ যেমন, এখনই বললুম, ‘রাম’, ‘নারায়ণ’ ইত্যাদি অনেক নাম৷ একটা নাম ‘নারায়ণ’৷ ‘নারায়ণ’ মানে কী?

‘নার’ আর ‘অয়ণ’ মিলে হ’ল নারায়ণ৷ অয়ণ মানে আশ্রয় (shelter)৷ মনে কর, কোনো পাত্রে জল রেখেছ, তাহলে পাত্র হ’ল জলের আধার৷ ‘অয়ণ’ জলের আশ্রয়৷ ‘নার’ অর্থাৎ পরমাপ্রকৃতি, জগত সৃষ্টিকারী, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টিকারী যে পরমাপ্রকৃতি, তার যে অয়ণ– তিনি হলেন নারায়ণ৷ পরমাপ্রকৃতি যিনি সবকিছু করেন, সবকিছু করতে পারেন, তাঁরও ইনি আশ্রয়৷ কত সুন্দর অর্থ৷ যে পুস্তকে ‘রাম’য়ের ‘অয়ণ’ পাওয়া গেল, তা রামায়ণ৷ তাই হনুমান কী বললেন? বললেন, ‘রাম’ আর ‘নারায়ণ’ দুই–ই এক, কিন্তু আমার কাছে রামই যথাসর্বস্ব৷ কেননা ‘রাম’ই যে তাঁর ইষ্টমন্ত্র৷ তোমাদেরও নিজের ইষ্টমন্ত্র আছে৷ তাই তোমাদের কাছে সর্বস্ব৷

‘রাম’ শব্দেরও তিনটে মানে, কিন্তু দেখবে তিনেরই মানে এক ইষ্টমন্ত্র৷

পরমাত্মার এক নাম ঈশ্বর৷ লোকে বলে ঈশ্বর, পরমেশ্বর৷ ঈশ্বর শব্দেরও নানান অর্থ আছে৷ একটা অর্থ ‘ঈশতে যঃ স ঈশ্বরঃ’৷ ‘ঈশ্’ ধাতুর মানে– ‘‘to control, to regulate’’– নিয়ন্ত্রণ করা, পরিচালিত করা৷ এটা করো, এটা করো না  এমন পাপ করবে তো এইভাবে আঘাত পাবে– সরিয়ে দোব, শেষ করে দোব৷ খাওয়ানো, শোয়ানো, দেখাশুণা করা– কখনো ভালবেসে, কখনো বকেঝকে নিয়ন্ত্রণ করা৷ তাই যিনি শাসন করেন, নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি হলেন ঈশ্বর৷ ‘ঈশ্’ মানে ‘to control’৷

গুরুরও এই কাজ৷ গুরু সম্পর্কে তন্ত্রে বলা হয়েছে– ‘নিগ্রহানুগ্রহে শক্তঃ গুরুরিত্যভিধীয়তে’– যিনি খুব শাসন করেন আর খুব ভালবাসেন, তিনি হলেন গুরু৷ কেবল বকাঝকা করেন, শাসন করেন, তিনি গুরু নন, শত্রু৷ আবার শুধুই ভালবাসেন, তিনিও গুরু নন, শত্রু৷ যিনি ভালও বাসেন আর বকাঝকাও করেন, তিনিই গুরু৷

পরমাত্মার সম্বন্ধেও এ কথা বলা হয়েছে৷ ভালবাসা আবার বকাঝকাও করা৷ কেবল বকাঝকা করলে মানুষ খারাপ হয়ে যায়৷ আবার কেবল ভালবাসলেও খারাপ হয়ে যায়৷ সেজন্যে খুব খাওয়াবে–দাওয়াবে আর অন্যায় করলে একটু বকাঝকাও করবে৷

‘‘য একো জালবাণীশত ঈশনীভিঃ’’– ঈশ্বর বিরাট বড় জাদুগর৷ তিনি তাঁর নিজের জাদুবলে সমস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করছেন৷ তাই ‘ঈশ’–এর একটা মানে নিয়ন্ত্রক– ন্তুপ্সুব্ধব্জপ্সপ্তপ্ত্৷ ‘ঈশ’–এর দ্বিতীয় মানে– ‘ক্লেশ–কর্র্ম–বিপাকাশ্ পরামৃষ্টঃ পুরুষবিশেষ ঈশ্বরঃ’– যিনি ক্লেশ, কর্ম, বিপাক ও আশয়ের দ্বারা অপরামৃষ্ট ব্ভুত্রব্দব্দ্ত্রন্প্তন্দ্ অর্থাৎ প্রভাবিত হন না৷ যাঁর ওপর এ সবের কোনো প্রভাব পড়ে না– এই যে বিশেষ পুরুষ ইনি হলেন ঈশ্বর৷

ভক্তরা বলেন– ‘স ঈশ্বর অনির্বচনীয়ঃ পরমপ্রেমস্বরূপঃ’৷ যাঁর কাছে এলে, যাঁর সান্নিধ্যে এলে, যাঁর কথা চিন্তা করলে, যাঁর নাম নিলে মনে ভালবাসা জাগে তিনি হলেন ঈশ্বর৷ দেখলে তো হবেই, মনে ভাবলেও, নাম নিলেও মনে ভালবাসার উদয় হবে৷ তিনিই ঈশ্বর৷

যোগীরা বলে থাকেন, যাঁর মধ্যে ঐশ্বর্য আছে তিনিই ঈশ্বর৷ ‘ঐশ্বর্য’ কাকে বলে? ইংরেজীতে বলে প্সন্তুন্তুব্ভপ্তব্ধ হ্মপ্সভ্রন্দ্বব্জ, অর্থাৎ অলৌকিক শক্তি৷ মানুষের মধ্যে যে শক্তি নেই– যাঁর মধ্যে সেই অলৌকিক শক্তি আছে, ঐশ্বর্য আছে তিনিই ঈশ্বর৷ ঐশ্বর্য মূলতঃ আট প্রকার– অনিমা, লঘিমা, মহিমা, প্রাপ্তি, ঈশিত্ব, বশিত্ব, কায়বসায়িত্ব, প্রকাম্য৷ এদের বলা হয় ঐশ্বর্য৷ ‘অনিমা’– যেমন, মন চাইলে নিজেকে ছোট থেকেও ছোট করে নেওয়া৷ যা ছোট বস্তু তা তো সব জায়গায় ঢুকে যাবে৷ ‘লঘিমা’ মানে খুব হাল্কা– খুবই হাল্কা৷ হাল্কা হয়ে গেলে যে কোনো জায়গায় ওপরে উঠে যেতে পারবে৷ ‘মহিমা’ মানে নিজেকে অনেক বড় করে দেওয়া৷ ‘প্রাপ্তি’ মানে যখন যা চাইবে তা পেয়ে যাওয়া৷ ‘ঈশিত্ব’ মানে সবার ওপর শাসন করা, সবাইকে নিয়ন্ত্রণ করা৷ ‘বশিত্ব’ মানে সবাইকে নিজের বশে করে নেওয়া৷ ‘কায়বসায়িত্ব’ মানে, মন চাইলে এখানে বসেই হাজারটা শরীর করে নেওয়া৷ এক হাজারটা শরীর কাজ করছে অথচ তিনি একই জায়গায় বসে আছেন৷ ‘প্রকাম্য’ মানে যখন যেমন চাইবেন তখন তেমন করে