২১শে ফেব্রুয়ারী ও সমাজ আন্দোলন

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

২১শে ফেব্রুয়ারী বাঙলা ও বাঙালীর গর্ব, বাঙলা ও বাঙালীর গৌরব৷ ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী ওপার বাঙলার বিশেষ করে ছাত্র, যুবসমাজ সমস্ত প্রকারের সংকীর্ণতার ঊধের্ব উঠে মাতৃভাষা বাংলার প্রতি ভালবাসার টানে যেভাবে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সমুদ্রের মত উত্তাল হয়ে উঠেছিল ও সমস্ত গোঁড়া ধর্মমত ও সাম্প্রদায়িকতার সমস্ত প্রাচীরকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল, ইতিহাসে তার তুলনা নেই৷ যুবজাগরণ সম্পর্কে কাজী নজরুল বলেছিলেন---

‘এই যৌবন জলতরঙ্গ রুধিবে কি দিয়া বালির বাঁধ

কে রোধিবে এই জোয়ারের জল গগনে যখন উঠেছে চাঁদ৷’

যথার্থই সমস্ত ডগমার বাঁধ সেদিন বালির বাঁধের মতই প্রবল তরঙ্গাঘাতে নিশ্চিহ্ণ হয়ে গিয়েছিল৷

অবিভক্ত বাঙলায় বিংশ শতাব্দীর গোড়াকার অগ্ণিযুগেও আমরা সেই চিত্র দেখেছিলুম৷ বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনেও সেদিন বাঙলায় এমনি প্রবল আন্দোলন তৈরী হয়েচিল ও জড়তার সমস্ত বাঁধ ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিল৷

ওপার বাঙলার মানুষের বাংলা ভাষা ও বাংলা সংস্কৃতির প্রতি টান শেষ পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানের মোল্লাতন্ত্রের সঙ্গে লড়াই করে স্বাধীন বাঙলাদেশের জন্ম দিয়েছে৷ সাম্প্রতিক কালের শাহবাগের আন্দোলনও দেখিয়ে দিয়েছে বাঙলার ভাষা সংস্কৃতির প্রতি বাঙালীর আকর্ষণ কতখানি৷

কিন্তু ভাববার কথা, ওপার বাঙলায় একুশে ফেব্রুয়ারীকে নিয়ে যে আবেগ যে উচ্ছ্বাস, এপার বাঙলায় কিন্তু তার, বলা চলে, বর্তমানে বিন্দুমাত্র দেখা যাচ্ছে না৷ একুশে ফেব্রুয়ারী এই বাঙলার সর্বাধিক প্রচারিত বাঙলা পত্রিকাগুলোতে এই গৌরবময় দিবস সম্পর্কে কোনও লেখাই দেখা গেল না৷ এদিন বাঙলায় একুশে ফেব্রুয়ারী সম্পর্কে তেমন কোনও উচ্ছ্বাস, তেমন কোনও অনুষ্ঠানও দেখা গেল না৷ দুই-এক জায়গায় পার্টির প্রচারের জন্য যেটুকু না করলে নয়, সেটুকু দেখা গেল মাত্র৷

এখন এপার বাঙলার তথাকথিত একদল শিক্ষিত মানুষ ছাত্র-যুবা ও বুদ্ধিজীবী সমাজ বাংলা বলার চেয়ে ইংরেজী বা বাংরেজীতে (বাংলা+ ইংরেজী মিলিয়ে) কথা বলাই পছন্দ করেন৷ তথাকথিত শিক্ষিত বাঙালীদের অভিভাবক-অভিভাবিকাদের গর্ব করে বলতে শোনা যায় ‘‘আমার ছেলেটা/মেয়েটার বাংলা ঠিক আসে না, সব সময় ইংরেজীতে কথা বলে৷’’ ঘরে তো মধুর ‘মা-বাবা’ সম্বোধন ছেড়ে ‘ম্যাম্মি-ড্যাডি’ বলতেই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে৷ বাঙলার বড় বড় মনীষীদের সম্পর্কে তাদের কোনও জ্ঞানই প্রায় নেই৷ কিন্তু আমেরিকান, ব্রিটিশ, ফরাসী সাহিত্যিক থেকে শুরু করে অভিনেতা-অভিনেত্রীদেরও নাম-ধাম ঠোসস্থ৷ উচ্চশিক্ষিত হলে এই ‘থার্ড ওয়ার্ল্ড’ কান্ট্রিতে পড়ে না থেকে বিদেশেই পাকাপাকি চাকরী করতে ভালবাসেন৷

এই ভারতের বাঙালী নেতা-নেত্রীদেরও অধিকাংশের নিজেদের বাঙালী বলতে---বাংলায় কথা বলতে অনীহা৷ লোকসভায় দাঁড়িয়ে এই পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সমস্ত  নেতা-নেত্রীদের হিন্দী-ইংরেজীতে ভাষণ দিতে দেখা যায়৷  বাংলা ভাষার মর্যাদাকে তাঁরা প্রতিষ্ঠিত করতে চান না৷ যদিও রাষ্ট্র সংঘেও বাংলা ভাষণ স্বীকৃত৷ মুজিব রাষ্ট্রসংঘতে বাংলাতেই ভাষণ দিয়েছিলেন৷ এই বাংলায় ও বাঙালী রাজ্য ত্রিপুরা, ঝাড়খণ্ড সহ এই ভারতে বাংলা ভাষী অন্যান্য এলাকায় অফিস-আদালতে বাংলায় কাজকর্ম হয় না৷ হয় ইংরেজী বা হিন্দীতে৷ বড় বড় শহরের দোকানের সাইনবোর্ডও বাংলার পরিবর্তে ইংরেজীতে লেখা৷

শিক্ষিত মানুষদের অনেককে বলতে শোণা যায়, এখন আন্তর্জাতিকতার যুগ, কুপমণ্ডুক হয়ে থাকলে চলবে না৷ ‘বাঙলা ও বাঙালী’ নাকি ক্ষুদ্র সেণ্টিমেণ্ট৷ তাদের কথা, ক্ষুদ্র সেণ্টিমেণ্টে আবদ্ধ থাকলে চলবে না!

আসলে মানব সমাজ একটা ফুলের বাগান৷ বাগানের প্রতিটি ফুলের গাছ যদি পুষ্ট হয়, প্রতিটি গাছ যদি ফুলে ফুলে ভরে যায়---তবে না বাগানের সৌন্দর্য৷ তেমনি মানব সমাজের প্রতিটি ভাষা-সংস্কৃতি তথা জনগোষ্ঠী যদি ঠিকভাবে বিকশিত হয়, তবে তো মানব সমাজের সামগ্রিক বিকাশ হবে৷ মালার এক-একটি ফুল যদি না সুন্দর হয়, সুন্দর মালা হবে না৷ তাই যারা বাংলা ও বাঙালীর জাতিসত্তা সম্পর্কে চিন্তাভাবনাকে সংকীর্ণ সেণ্টিমেণ্ট বলেন তাঁরা মুর্খের স্বার্গে বাস করছেন৷ তাঁরা সমাজের যথার্থ বিকাশ চান না, তাঁরা সুবিধাবাদী ও কেবল আত্মসুখতত্ত্বে বিশ্বাসী৷ সমষ্টির কল্যাণের তাঁরা পরিপন্থী৷

প্রাউট তত্ত্বে বিশ্বাসী ‘আমরা বাঙালী’ দল, বাঙলা ও বাঙালী জাতিকে সুসমৃদ্ধ করার জন্যে আন্দোলন করে চলেছে, তাঁদের এই আন্দোলন কি বিশ্বৈকতাবাদের পরিপন্থী? মোটেই নয়৷ প্রাউটের আদর্শই তো ‘আঞ্চলিক শ্রীবৃদ্ধির পথ ধরে বিশ্বৈকতাবাদের প্রতিষ্ঠা৷’ বিশ্বের প্রতিটি জনগোষ্ঠী যদি সর্বাত্মক শোষণমুক্ত ও সামাজিক-অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সমুন্নত না হয়, তাহলে বিশ্বৈকতাবাদ প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না৷ শোষকের সঙ্গে শোষিতের প্রকৃত বন্ধুত্ব হয় না৷ প্রতিটি এলাকা শোষণমুক্ত ও সামাজিক-অর্থনৈতিকভাবে স্বয়ংসস্পূর্ণ না হলে প্রকৃত বিশ্ববন্ধুত্ব আসতে পারে না৷ এই সর্বাত্মক শোষণমুক্তির ও সমৃদ্ধির জন্যেই ‘প্রাউট’ দিয়েছে ‘সমাজ’ আন্দোলনের তত্ত্ব৷ বিশ্বের সমস্ত অঞ্চল ও সমস্ত জনগোষ্ঠী এই পথ ধরে সর্বপ্রকারের শোষণমুক্ত ও সর্বপ্রকারে সুসমৃদ্ধ হতে পারে৷ এছাড়া বিশ্ব মানব সমাজের সামূহিক কল্যাণের জন্য কোন পথ নেই৷