বিজ্ঞান হোক সেবা ও কল্যাণের জন্যে

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই অর্থাৎ আনুমানিক দশ লক্ষ বছর আগে– পৃথিবীতে মানবজাতি আসার ঊষালগ্ণ থেকেই–বিজ্ঞানের সঙ্গে মানুষের জীবন অচ্ছেদ্যভাবে সম্পর্কিত৷ যতদিন পর্যন্ত একজন মানুষও থাকবে ততদিন বিজ্ঞানের যুগ থাকবে।

জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সর্বাত্মক জয়লাভের ইচ্ছা মানুষের মধ্যে আদিম ও অনন্ত প্রয়োজনীয় বা অপ্রয়োজনীয়–জীবনের সকল ক্ষেত্রে ছোট হয়ে বাঁচাটা মানুষের পক্ষে অভাবনীয়৷ অনন্তকাল ধরে’ প্রকৃতির আজ্ঞাবহ ভৃত্য হিসেবে বাঁধাধরা পথে চলার ধারণা কোনদিনই তার মনঃপুত নয়৷ যেহেতু তাকে টিকে থাকতে হয় আপাতঃ প্রতিকূল স্থূল জগতে, তাই তমোগুণী প্রকৃতিকে জয় করতে গিয়েই উদ্ভব হয়েছে Science বা ভৌতিক বিজ্ঞানের৷

স্থূল ভৌতিক জগতের সংগ্রামে পরাজয়ের সম্ভাবনা দেখলে মানুষ তৎক্ষণাৎ সংগ্রামের উদ্দেশ্যে নোতুন অস্ত্রশস্ত্রের প্রস্তুতির আয়োজন শুরু করে’ দেয়৷ আর ভৌতিক বিজ্ঞানের কাজ হ’ল – নিতি নিতি ফরমূলা বের করে’ প্রস্তুতির কাজে সহায়তা করা৷ যদি কোনদিন দৈহিক সংঘর্ষ না চলত, তাহলে মানব মনের সৃষ্টি বা বিবর্ত্তন কোনদিনই সম্ভব হত না৷ আজকের সূক্ষ্ম মানব–মনীষার আবির্ভাব সম্পূর্ণ অজ্ঞাতই থেকে যেত৷ এটা সকল জীবের মধ্যেই হয়ে চলেছে, ও তা থেকে সকল জীবই নিজ নিজ মানসিক প্রবণতা ও শক্তি অনুযায়ী বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার অনুবর্ত্তন করে চলেছে৷

দৈহিক তথা মানসিক অসুবিধাগুলো দূর করার জন্যেই কোন এক বিশেষ যুগের মানুষ গো–গাড়ীর উদ্ভাবন ও প্রচলন করেছিলেন৷ কিছুদিন পর আবার অধিকতর দ্রুতগামী অশ্বযানের প্রচলন শুরু হ’ল৷ পরবর্ত্তীকালে যুগের পরিবর্ত্তনের সঙ্গে সঙ্গে চাহিদারও পরিবর্ত্তন হতে লাগল৷ তাই বিভিন্ন যুগে বিভিন্নতর যানবাহন–মোটরগাড়ী, এরোপ্লেন ও সাম্প্রতিককালে রকেট আবিষ্কৃত হয়েছে৷ এগুলোর কোনটাই নিন্দনীয় নয়–এগুলো শুধুমাত্র যুগের সন্ধিক্ষণে পরিবর্ত্তিত মানসিক চাহিদা পূরণ করার বিভিন্ন মাধ্যম মাত্র৷ স্থূল ভৌতিক জগতের সংঘর্ষ সুপ্ত মানবশক্তিকে ক্রমেই প্রস্ফুট করে’ তোলে৷ পরিবেশগত প্রভাবও মানবদেহে জটিলতার পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়৷ প্রাচীন ও আধুনিক মানুষের সমস্যাবলী কোন ক্রমেই এক ধরণের নয়৷ সমস্যার পরিবর্ত্তনের গতিধারার সঙ্গে তাল রাখতে গিয়ে মানবদেহ ও মন ক্রমেই জটিলতর হয়ে উঠেছে৷ মনের জটিলতার সঙ্গেই সঙ্গেই তার প্রত্যক্ষ স্থান স্নায়ুকোষগুলো ও পরোক্ষ স্থান গ্রন্থিগুলোর মধ্যে অনুরূপ প্রয়োজনীয় পরিবর্ত্তন সংঘটিত হয়ে চলেছে৷ সমস্যার পরিবর্ত্তনের জন্যে মানুষের মনও নোতুন নোতুন বৈজ্ঞানিক আবিষ্ক্রিয়ায় নিযুক্ত হয়ে রয়েছে৷ এ থেকেই আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, বৈজ্ঞানিক অনুশীলনকে ক্রমেই এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে, ও তা কোনদিনই মানবপ্রগতির পরিপন্থী হয়ে উঠবে না৷ কিন্তু বিজ্ঞানের সমালোচকদের অধিকাংশই কেবল ভাবাবেগের মাথায় এই সহজ সত্যটা স্বীকার করতে চায় না৷

যারা বিজ্ঞানের সমালোচনা করে, তারা প্রকৃত প্রস্তাবে গঙ্গার ধারাপ্রবহাকে উল্টোদিকে অর্থাৎ গঙ্গোত্রির দিকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চায়–যা হচ্ছে সম্পূর্ণতই গতিধর্ম বিরোধী৷ এ ধরণের প্রচেষ্টা ঋণাত্মক মানসিকতার পরিচয় দেয়৷

সময়ের পরিবর্ত্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মনকে সর্বদাই বিভিন্ন প্রগতিশীল চিন্তা ও কর্মপদ্ধতিতে ব্যাপৃত থাকতেই হবে৷ এই সমস্ত নোতুন দায়িত্ব সম্পাদনে সক্ষম হবার জন্যে মানুষের মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষগুলোর মধ্যে প্রয়োজনীয় পরিবর্ত্তন সংঘটিত হয়ে চলেছে৷ এর সঙ্গে দৈহিক গ্রন্থিগুলোর কঠোমোও পরিবর্তিত হচ্ছে৷ এতে করে’ শুধু যে মানুষের দেহ ও মনের সংরচনা জটিলতর হচ্ছে তা নয়, মানুষের সমগ্র সমাজেও সেই জটিলতা এসে পড়েছে৷ বিভিন্ন সমস্যাও উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে৷ এ অবস্থায় আমাদের উচিত, যথাযথ বৈজ্ঞানিক অনুশীলনের দ্বারা ওই সব সমস্যার যথার্থ সমাধান বের করা৷ কথায় বলে–যেমন তরবারি, তেমনই তার আধার৷ এজন্যে যত জটিল সমস্যা আছে, ততই জটিল বৈজ্ঞানিক উপকরণের উদ্ভাবন করতে হবে৷

বিজ্ঞান হবে সেবা ও কল্যাণের জন্যে৷ বিজ্ঞান সর্বদাই মানব সমাজের যথার্থ প্রগতির জন্যে প্রযুক্ত হওয়া উচিত৷

মানব প্রগতির জন্যেই আমরা বিজ্ঞানচর্চাকে অভিনন্দন জানাই৷ কিন্তু এই বিজ্ঞান চর্চা অবশ্যই সদ্বিপ্রদের তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন হওয়া বাঞ্ছনীয়৷ সদ্বিপ্রের দ্বারা বিজ্ঞানের যথার্থ অনুশীলনের ফলে ব্যষ্টিগত তথা সামাজিক বহু সমস্যার সুন্দর সমাধান হতে পারে৷ পৃথিবীর সকল দেশেই আজও কম বেশী যে ভূমি সমস্যা রয়েছে, বিজ্ঞান অনেকাংশে তার একটা সহজ সমাধান করে’ দিতে সক্ষম৷ খাদ্য–সামগ্রীর প্রয়োজনীয়তা কম থাকলেই ভূমির গুরুত্ব তথা মূল্য আপনিই কমে যাবে৷ মানুষের ক্ষুধা নিবারণের জন্যে একটা বটিকাই যথেষ্ট হতে পারে৷ বৈজ্ঞানিক গবেষণাগারে এ ধরণের অনেক পরিমাণ বটিকা উৎপাদন ধনী–দরিদ্রের ভেদও অনেক ঘুচিয়ে দেবে–কারণ পাকস্থলীর জ্বালা দূর করার জন্যেই গরীবেরা বাধ্য হয়ে ধনীর দাসত্ব স্বীকার করে৷ অবশ্য এ রকমের সূক্ষ্ম–খাদ্য উৎপত্তির আগে থেকেই বিজ্ঞান নানান উপায়ে খাদ্য সমস্যার সমাধানে সহায়তা করছে৷ জনসংখ্যা বেড়েই চলেছে* তার তুলনায় জমির পরিমাণ বাড়ছে না৷ এই সীমিত ভূ–ভাগ নিয়েই লোকেরা বিজ্ঞানের সহায়তায় উন্নত ধরণের সার, শস্য–বীজ, জলসেচ–ব্যবস্থা ইত্যাদির মাধ্যমে খাদ্যোৎপাদনের পরিমাণ বাড়িয়ে নিচ্ছে৷ তাহলেই দেখছি মানব–প্রগতির পক্ষে বিজ্ঞান অত্যাবশক৷

বিজ্ঞানের শুভ প্রয়োগের দ্বারা সামূহিক অর্থনৈতিক–ব্যবস্থায়্ মানুষের কল্যাণই হবে৷ এমনও হতে পারে যে, যান্ত্রিকীকরণের ফলে হপ্তায় পাঁচ মিনিটের বেশী কাউকে মেহনত করতে হবে না৷ অন্নবস্ত্রের চিন্তায় সর্বদা ব্যস্ত থাকতে না হওয়ায় তার মানস তথা আধ্যাত্ম–সম্পদের অপচয়ও হবে না৷ খেলা–ধূলা, সাহিত্যচর্চা তথা অধ্যাত্ম–সাধনায় সে অনেক বেশী সময় ব্যয় করতে পারবে৷ একই কথা শোণানো হতে থাকে তবে মানুষ এক সময় ভাবে যে তাতে নিশ্চয়ই সত্যতা আছে, ও তার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়ে৷ জমিদারী ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও তাই–ই ঘটেছিল৷ জমিদারী ব্যবস্থা রদ্ হয়ে যাওয়ার পরে সরকারকে বেতন দিয়ে কর সংগ্রহ ব্যবস্থা বজায় রাখতে হ’ল যার খরচ নির্বাহ হত এই রাজস্ব বিভাগ থেকেই৷ জমিদারী ব্যবস্থা রদ্ করে সরকারের রাজস্বের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় নি৷ জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত না করে’ সরকার যদি পূঁজিপতিদের পূঁজির ওপরে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতেন, আর তাদের bank balance  আর সঞ্চিত স্বর্ণবিত্তকে সিলিং–এর আওতায় আনতেন, তাতে সমাজের বেশী উপকার হত৷ এছাড়া আরও নানা ভাবে জমিদারদের ক্ষমতা খর্ব করা ও চাষীদের স্বার্থ রক্ষা করা যেতে পারত৷ তার পরিবর্ত্তে সাধারণ মানুষকে নিরন্তর শোণানো হতে থাকল, যে চাষ করে’ জমি তার৷ এই যুক্তি যদি মেনে নিতে হয় তবে বলতে হয় যে দাড়ি কামায়, মাথার মালিকও সেই–ই৷           ১৩ জুলাই ১৯৮৮, কলিকাতা