‘দধীচির আত্মত্যাগ ব্যর্থ হয়নে’

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

পৃথিবীর ইতিহাসে কোনও মহান আদর্শ বিনা বাধায় প্রতিষ্ঠিত হয় নি৷ এই সত্য কথাটি আনন্দমার্গের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য৷ পাণ্ডব বর্জিত অখ্যাত গ্রাম পুরুলিয়া জেলার বাগলতা–যেখানে দিনে শেয়ালের ডাক শোনা যেত সেই অতি দরিদ্র গ্রামের স্থানীয় কিছু মানুষ উদরের ক্ষুণ্ণিবৃত্তির জন্যে এখানে ওখানে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াত পশু শিকারের জন্যে বা ঘাসের বীজ সংগ্রহ করত সেই শ্মশান ডাঙ্গায়৷ মার্গগুরু শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী শত শত গৃহত্যাগী সন্ন্যাসী–সন্ন্যাসিনীদ্ নিয়ে ও মার্গের গৃহী অনুগামীদের সহায়তায় বিশ্বের কল্যাণে এখানে এক সর্বানুসূ্যত আদর্শ আশ্রম গড়ে তোলেন অতি অল্প কয়েক বছরের মধ্যে আর স্থানটির নামকরণ করলেন ‘আনন্দনগর’৷ যাকে বলা যায় বিশ্বের কল্যাণের চক্রনাভি৷ কিন্তু সেই কল্যাণকামী কর্ম প্রচেষ্টা কিছু দুষ্কৃতীর কাছে অসহ্য হয়ে ওঠে৷ তারা নব নির্মিত আশ্রমের চরম ক্ষতি সাধনের জন্যে ষড়যন্ত্র করে ১৯৬৭ সালের ৫ই মার্চ বেলা ১০টা নাগাদ আনন্দনগর কেন্দ্রীয় কার্যালয় আক্রমণ করে৷ এই ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে ছিল কমিউনিষ্ট দল (সিপিআই, সিপিএম), স্থানীয় বিডিও ও বালি গ্রামের কুখ্যাত ডাকাত দল৷ 

আগের দিন রাত ১টা নাগাদ জনৈক মার্গের সন্ন্যাসী আনন্দনগরের ডাক্তারবাবু প্রয়াত আচার্য শচীনন্দন মহাশয়ের বাসায় এসে সংবাদ দেন যে আগামীকাল আশ্রম আক্রান্ত হতে পারে কারণ পুন্দাগ স্টেশন থেকে আসার সময় স্থানীয় লোকেরা এ ব্যাপারে কানা–ঘুঁষো করছে আর সারা রাত ধরে নিষিদ্ধ দেশী মদ ও মাংসের ভোজের আয়োজন করেছে৷ পরের দিন অদূরে যে রেল লাইন গেছে সেই লাইনের পাশে ও আশ্রমের সীমানায় দু’চার জন করে লোক জমায়েত হয়ে ওদের ডুগডুগি বাজিয়ে লোক জড়ো করতে দেখা যায়৷

মধ্য আনন্দনগর আশ্রমের কার্যালয়৷ ৫ই মার্চ সকালে সেদিকে তীর–ধনুক, ধারালো অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে একদল লোক চিৎকার করতে করতে এগিয়ে যায়৷ তৎকালীন জেনারেল সেক্রেটারী আচার্য অভেদানন্দ অবধূত নিরস্ত্র ভাবেই তাদের বোঝানোর চেষ্টা করেন৷ কিন্তু তারা আচার্য অভেদানন্দ, আচার্য সচ্চিদানন্দ অবধূত, আচার্য ভরতকুমার, আচার্য প্রভাস কুমার ও আচার্য অবোধ কুমারকে তীরের দ্বারা আহত করে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা করে৷ সংঘের সন্ন্যাসীরাও তাদের আক্রমণে প্রচণ্ডভাবে আহত হন৷ এদিকে আশ্রম আক্রান্ত হওয়ার খবর থানায় দেওয়া হয়৷ অনেক পরে আশ্রমে পুলিশ আসে৷ এদিকে আনন্দনগরের  হাসপাতালও আক্রান্ত হয়৷ তার আগে ডাক্তারবাবু পরিবারের সকলে মূল আশ্রমে চলে আসেন৷ কিন্তু ডাক্তারবাবু ডাক্তারখানায় থেকে যান৷ আক্রমণকারীরা এসে ডাক্তারখানা ও তাঁর বাসা লুট করে আগুন ধরিয়ে দেয়৷ উপায়ন্তর না দেখে মৃত্যু সুনিশ্চিত জেনেও বহু কষ্টে অনেক বাধা অতিক্রম করে ডাক্তার শচীনন্দনবাবু ছুটতে ছুটতে দীর্ঘ কাঁকুরে পথ অতিক্রম করে আশ্রমের দ্বারে পৌঁছে অজ্ঞান হয়ে যান৷ আশ্রমের ছোট ছোট পড়ুয়াদের একটি ঘরে তালাবন্ধ করে রাখা হয়েছিল যাতে তাদের কোন ক্ষতি না হয়৷

সাময়িক ভাবে আশ্রমবাসীরা রাঁচীর নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান৷ কিছুদিন পর পাপশক্তির ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে সকলে আবার ধীরে ধীরে আনন্দনগরে ফিরে আসেন৷ শুরু হয় নূতন করে আনন্দনগর গড়ে তোলার কাজ৷

পুরাণে বর্ণিত উপখ্যান অনুসারে বেত্রাসুরকে নিধন করার জন্যে মহামুনি দধীচি আত্মত্যাগ করেন৷ ‘দধীচি ত্যাজিলা  তনু দেবের মঙ্গলে’৷ তাঁর অস্থি দিয়ে যে বজ্র তৈরী হয় সেই বজ্রেই ইন্দ্র ভয়ঙ্কর অসুরকে  নিধন করেন৷ জগৎ কল্যাণে পাপ শক্তিকে ধবংস করতে ধর্ম ও সত্যকে প্রতিষ্ঠার জন্যে আনন্দনগরের বুকে তরতাজা পাঁচটি লাল গোলাপের মতো পবিত্র সন্ন্যাসী প্রাণ দিয়ে ৫ই মার্চ ইতিহাস সৃষ্টি করে গেছেন৷ তাঁরাও সেই মহান দধীচির মত৷

আনন্দমার্গের মহান আদর্শ, মানব–ধর্মের বিস্তার ঘটাতে ও আনন্দনগরকে দানবদের হাত থেকে রক্ষা করতে সেদিন ওই পঞ্চ মহান দধীচি আত্মত্যাগ করেন৷ আনন্দমার্গের ইতিহাসে ওই দিনটিকে তাই দধীচি দিবস হিসাবেই স্মরণ করা হয়ে থাকে প্রতি বছর৷ সারা পৃথিবীর আনন্দমার্গের সন্ন্যাসী–সন্ন্যাসিনী ও গৃহী অনুগামী ভক্তগণ এদিন সকাল হতে সন্ধ্যা পর্য্যন্ত কোন খাদ্য ও জল গ্রহণ না করে উপবাসের মধ্য দিয়ে তাঁদের শ্রদ্ধায় স্মরণ করে থাকেন৷ সেই দধীচিদের আত্মত্যাগ সফল হোক৷ পৃথিবীর বুকে ন্যায়, সত্য ও ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হোক এটাই কাম্য৷ স্মরণে থাকে যে স্থানীয় থানা পাঁচজন সন্ন্যাসীর নির্মম হত্যাকাণ্ডের ঘটনার এফ আই আর নেয় নি ও হত্যা মামলা রুজু করে নি৷ আহত প্রত্যক্ষদর্শী সন্ন্যাসীরা মহামান্য আদালতে আবেদন করে মামলা রুজু করেন৷ কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীরা পুরুলিয়া কোর্টে এই মামলার বিচারে বাধা প্রদান করে৷ তাই এই মামলার ন্যায় বিচারের জন্যে মেদিনীপুর সেসনকোর্টে স্থানান্তরিত করা হয়৷ সেখানে বাগলতার স্থানীয় বিডিও সহ ১৮ জন দুষ্কৃতীর বিচারে বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড হয়, তার মধ্যে আটজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড৷ মহামান্য বিচারপতি আশ্রমে পুলিশী নিষ্ক্রিয়তা ও সরকারী কাজে অবহেলার তীব্র সমালোচনা করেন৷ পঞ্চ দধীচির আত্মত্যাগ ব্যর্থ হয়নি৷ সে–দিনের সেই পাপশক্তি আজ অস্তিত্বের সংকটে পড়ে হাহাকার করছে৷ আনন্দমার্গ সব অত্যাচার, অবিচার ও প্রতিরোধের পাঁচিল ভেঙে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে বিশ্বের দেশে দেশে বিজয় নিশানি উড়িয়ে৷