হিম যুগ আসছে

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

ইতিহাস এগিয়ে চলে তরঙ্গায়িত ছন্দে ঊহ–বোহের দোলায়৷ সে চলে আর চলে তারপর দেয় একটা লাফ, আবার সে চলে, আবার দেয় লাফ৷ এই গতিতেই সে চলতে থাকে৷ কিন্তু হঠাৎ এক সময় তার এই চলনটা যায় বদলে৷ তার গতিতে আসে অতিরিক্ত দ্রুতি৷ সে তখন চলতে থাকে লাফিয়ে লাফিয়ে৷ শুরু হয় নোতুন যুগের সূচনা৷ আমরা এখন এ রকমই এক বিরাট পরিবর্ত্তনের প্রবেশদ্বারে এসে উপস্থিত হয়েছি৷ না, আমরা শুধুমাত্র এক নোতুন যুগের প্রবেশদ্বারেই উপস্থিত হইনি৷ আমরা সেই প্রবেশদ্বার অতিক্রম করেও ফেলেছি৷ বস্তুতঃ আমরা এখন একটা নোতুন যুগের মধ্য দিয়ে চলেছি৷ তোমরা কি তা অনুভব করতে পারছ? এখন তোমাদের বিরাট বিরাট পরিবর্ত্তনের জন্যে প্রস্তুত থাকতে হবে৷ নতুবা ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাবে৷

চলার পদ্ধতিতে গতি কখনও একটানা থাকতে পারে না৷ গতি সবসময়েই সঙ্কোচাত্মক ও বিকাশাত্মক হয়৷ গতি কখনও দ্রুত–আরও দ্রুত হয়৷ আবার কখনও বিলম্বিত–আরও বিলম্বিত হয়৷ এই ত্বরণ ও অবত্বরণের সঙ্গে থাকে উল্লম্ফন৷ এই উল্লম্ফনের আগে ও পরে জীবদেহে, ইতিহাসে, কৃষিকার্যে ও মানুষের মানসভূমিতে পরিবর্ত্তন ঘটে থাকে৷

প্রাণের বিকাশের দিক থেকে বিচার করলে পৃথিবীর ইতিহাসে দুইটি হিম যুগ উল্লেখযোগ্য৷ প্রথম হিম যুগের আগে পৃথিবীতে উন্নত প্রাণী প্রায় ছিলই না৷ শুধুমাত্র অনুন্নত প্রাণী ছিল৷ তারপর সব কিছু ঢ়াকা রইল বরফ আর তুষারে৷ প্রথম হিম যুগ শেষ হওয়ার পর অনেক বছর ধরে বিরাট পরিবর্ত্তন চলল৷ প্রাণীরা সব হয়ে গেল বিশালকায়৷ আবার দ্বিতীয় উল্লেখযোগ্য হিম যুগের পর বিশালকায় প্রাণীরা সব অবলুপ্ত হ’ল–এল ক্ষুদ্র আকৃতির প্রাণী৷ প্যালিওসিন (Paleocene), অলিগোসিন (Oligocene) ও মায়োসিন (Miocene) যুগ এল৷

আমরা জানি পৃথিবীতে আরেকটা হিম যুগ আসছে৷ এটা পৃথিবীর পরিকাঠামোর পুরো পরিবর্ত্তন আনবে৷ এই হিম যুগ আসার আগেই মানুষ ও পশু, প্রাণীন ও অপ্রাণীন সকল সত্তার ৰৌদ্ধিক ও শারীরিক বিরাট পরিবর্ত্তন হবে৷ ঋতুর পরিবর্ত্তন, মানসিক পরিবর্ত্তন, সামাজিক–অর্থনৈতিক– ও সাংস্কৃতিক পরিবর্ত্তন, জীবদেহে পরিবর্ত্তন–এসব তোমরা দেখবে৷ সব কিছুরই রূপান্তর ঘটছে৷ দুই মেরুর অবস্থানের পরিবর্ত্তন শুরু হয়েছে৷ তোমরা কি এ সবের জন্যে প্রস্তুত?

আগামী হিম যুগের পর ক্রান্তিবলয়ের অঞ্চলগুলির পরিবর্ত্তন হবে ও বিপুল পরিমাণে জৈবিক পরিবর্ত্তন হবে–একটা বিশেষ বর্গের সৃষ্টি হবে৷ তোমরা কি অনুভব করতে পারছ যে ঋতুচক্রের পরিবর্ত্তন হচ্ছে ও তাতে একটা বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে? উত্তর মেরু পূর্ব গোলার্ধে বিপরীত ক্রান্তি অঞ্চলের দিকে সরছে আর দক্ষিণ মেরু পশ্চিম গোলার্ধে বিপরীত ক্রান্তি অঞ্চলের দিকে সরে, আসছে৷

যদি পূর্ব গোলার্ধে উত্তর মেরু উত্তর থেকে দক্ষিণে সরে ও পশ্চিম গোলার্ধে দক্ষিণ মেরু উত্তর দিকে সরে তবে পৃথিবীর জলস্তরের ওপর তার কী প্রভাব পড়বে? মেরু অঞ্চলের সমস্ত বরফ গলে যাবে ও সমুদ্রের জলস্তরের উচ্চতা বাড়বে৷ সারা পৃথিবী জুড়ে সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের ওপর এর প্রভাব পড়বে৷ প্রশান্ত মহাসাগর ঠাণ্ডা হতে থাকবে ও তারপর একদম জমে যাবে৷ বর্ত্তমানে চালু অনেক সামুদ্রিক বন্দর বন্ধ হয়ে যাবে৷ ঋতুর অনুক্রম বদলে যাবে৷ বৃষ্টিপাত ও আবহাওয়ার পরিবর্ত্তন উদ্ভিদ ও জীবকুলে বিরাট প্রভাব ফেলবে৷ এইসব কিছু মিলে একত্রে চিন্তনের ক্ষেত্রে বিরাট প্রভাব ফেলবে৷ সৌরবর্ষে দিনের সংখ্যা ইতোমধ্যে ৩৬৫ থেকে ৩৬৬ হয়েছে কিন্তু চান্দ্রবর্ষে দিনের সংখ্যা সেই ৩৫৪–৩৫৫–তেই অপরিবর্ত্তিত রয়েছে৷

ৰুদ্ধিমান ব্যষ্টি হিসেবে অবশ্যই এ ধরনের অবশ্যম্ভাবী বিপুল পরিবর্ত্তনের জন্যে তোমাদের প্রস্তুত থাকা উচিত৷ আগে কলকাতায় (কালবোশেখী) ঝড় হত সন্ধ্যা ছটা থেকে নটার মধ্যে৷ কিন্তু এখন বিকেল মাত্র ৪–১৫ মিনিট অথচ ঝড় উঠেছে৷ ঋতুর পরিবর্ত্তন হচ্ছে আর তাই আবহাওয়ারও বিরাট পরিবর্ত্তন দেখা দিচ্ছে৷

কোনো একসময় পৃথিবীর সমস্ত নিপীড়িত মানুষের এটাই ধারণা ছিল যে সাম্যবাদই ন্তুপ্সপ্পপ্পব্ভুন্ব্দপ্ তাদের সমস্ত সমস্যার একমাত্র সমাধান৷ কিন্তু কম্যুনিষ্ট নেতারা মনুষ্যত্ব, বিচারৰোধ ও মানসিক মনস্তত্ত্বের বিরুদ্ধাচরণ করেছে ও মানবসভ্যতার মূল ভিত্তিতে আঘাত হেনেছে৷ ফলে জনসাধারণ এখন লক্ষ লক্ষ নিরীহ মানুষকে হত্যার জন্যে তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে৷ কম্যুনিষ্ট শাসকদের পতনের ফলে আদর্শের ক্ষেত্রে একটা শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে৷ এই শূন্যতাকে তোমাদের ৰুদ্ধিবৃত্তি ও আদর্শ দিয়ে পূরণ করতে হবে৷ এটা তোমরাই করবে, আর তা হবে প্রাউটের দ্বারা৷ এ কাজ অদূর ভবিষ্যতেই করতে হবে৷ দেরী করার সময় আর নেই – নেই কোনো বিকল্পও৷

মার্কসবাদ কেন পরিবর্ত্তিত হচ্ছে? জীবনের সর্বক্ষেত্রে রূপান্তর অবশ্যম্ভাবী৷ রূপান্তর শুধুমাত্র বস্তুজগতেই ঘটছে না, মানসিক স্তরেও সেটা ঘটছে৷ মানসিক স্তরে ও জীবনের অভিপ্রকাশের সকল স্তরে পরিবর্ত্তন অত্যন্ত দ্রুত আসছে৷ তারা শুধু আসছে না, তারা এসেও গেছে৷ আমরা এক নোতুন যুগের প্রবেশদ্বার পার হয়েও গিয়েছি৷

প্যালিওজোয়িক  (Paleozoic) যুগে কোনো বৃষ্টিপাত ছিল না৷ বৃষ্টির জলও ছিল না৷ গ্যাসীয় পৃথিবীতে ছিল না কোনো গাছপালা৷ তোমাদের সরকার–সমাজ ছিল না, রয়্যালসীমা সমাজ ছিল না৷ অন্ধ্র ভূখণ্ডটাই ছিল না৷ অনেক পরে অন্ধ্রের একটা অংশ ও ছোট প্রাণীরা এল৷ কিন্তু তখনও কোনো সৈকতভূমি ছিল না আর বিশাখাপত্তনমও ছিল না৷ মেডাক কিন্তু ছিল৷ এরপর প্রচুর বৃষ্টিপাত হ’ল৷ ক্রমে পাহাড়গুলি তুষারে ঢ়েকে গেল ও নদীগুলো বরফজলে পুষ্ট হ’ল৷ গোদাবরী, কৃষ্ণা ও কাবেরী নদীগুলি বরফজলে পুষ্ট ছিল৷ নদীগুলি স্থায়ী জলের উৎস ছিল৷ কিন্তু তখন কোনো মানুষ ছিল না৷ এই হচ্ছে একনজরে অন্ধ্রপ্রদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক ইতিহাস৷ ডাইনোসোরাস, ৰ্রুন্টোসোরাস প্রভৃতি অনেক বড় বড় প্রাণী এসেছিল৷ তারপর এল অলিগোসিন (Oligocene) ও মায়োসিন (Miocene) যুগ৷ এরপরে প্লায়োসিন Pliocene) যুগের শেষ ভাগে এল মানুষের পূর্বসূরী৷ মানুষের প্রথম জন্ম হয়েছে প্রায় দশ লক্ষ বৎসর আগে৷ প্রায় দশ লক্ষ বৎসর পরে এই গ্রহে কোনো মানুষই থাকবে না৷ ভবিষ্যতের প্রজন্মের বর্তমান প্রজন্মেরা শুধুমাত্র কঙ্কালের জীবাশ্ম দেখতে পাবে৷

এই পৃথিবীর প্রতিটি জিনিস পরিব্যক্তি (mutation) ও উপস্কৃতির (transmu-tation) মধ্য দিয়ে পরিবর্ত্তিত হয়ে চলেছে৷ পরিব্যক্তি (mutation) ও উপস্কৃতি (transmutation) শুধুমাত্র বস্তুজগতেই হয় না, জীবিত প্রাণীর মানসিক ক্ষেত্রেও হয়৷ অজৈব পদার্থের বিকাশোন্মুখ সুপ্ত মানসসত্তারও পরিবর্ত্তন হয়৷ প্রাণীন ও অপ্রাণীন বস্তু অভিপ্রকাশের অপেক্ষায় আছে৷ প্রথম হিম যুগের পর মানস ক্ষেত্রে বিপুল পরিবর্ত্তন হয়েছিল৷ ৰৃহৎ প্রাণীদের আবির্ভাব হয়েছিল৷ আবার দ্বিতীয় হিম যুগের পর আরেকটা বিরাট পরিবর্ত্তন হ’ল৷ ৰৃহৎ প্রাণীদের অস্তিত্ব আর রইল না৷ ছোট জন্তুরা এল৷ ম্যামথ হয়ে গেল হাতি৷

বর্ত্তমান যুগটা বড় জন্তু আর ছোট রাষ্ট্রের জন্যে নয় কারণ বড় জন্তুদের খাদ্য পাওয়া কঠিন হবে আর ছোট রাষ্ট্রের সংহতি রাখা মুস্কিল হবে৷ দ্বিতীয় হিম যুগের পর ম্যামথ অবলুপ্ত হ’ল ও হাতির আবির্ভাব হ’ল৷ কৃষ্ণা, কাবেরী ও তুঙ্গভদ্রা নদী আজ ভারতীয় অন্তরীপের অংশ কিন্তু আজ থেকে ৩০ কোটি বৎসর আগে তারা গণ্ডোয়ানা ভূখণ্ডের অংশ ছিল৷ মানুষ পৃথিবীর বুকে এসেছে আজ থেকে প্রায় দশ লক্ষ বৎসর আগে৷ এ সবই পরিব্যক্তি (mutation) ও উপস্কৃতির (transmutation) উদাহরণ৷

বর্ত্তমানে সাম্যবাদ ন্তুপ্সপ্পপ্পব্ভুন্ব্দপ্ অন্তর্হিত হয়ে গিয়েছে৷ উন্নততর চিন্তাধারা ও উন্নততর মানসিক লব্ধির সুযোগ এসেছে৷ এই পরিবর্ত্তনটা সস্পূর্ণরূপে স্বাভাবিক৷ এটা কোনো বিপর্যয় নয়৷ অন্য দর্শনগুলোও নিশ্চিতরূপে পরাভূত হবে৷ কয়েক বৎসর আগে বলেছিলুম যে সাম্যবাদকে ন্তুপ্সপ্পপ্পব্ভুন্ব্দপ্ অবশ্যই সরে যেতে হবে৷ তখন মনে হয়েছিল যে এটা একটা স্বপ্ণ মাত্র৷ কিন্তু সেই স্বপ্ণই আজ বাস্তবায়িত হয়েছে৷ এই পরিবর্ত্তনটা স্বাভাবিক৷ এটা কোনো আকস্মিক বিপর্যয় নয়৷ আগামী পরিবর্ত্তনের জন্যে প্রস্তুত হও ও তার প্রস্তুতি নাও৷ এটাই স্বাভাবিক৷ এদের কখনও নজিরবিহীন দুর্যোগ বা বিরাট বিপর্যয় অথবা ভীষণ প্রতিকূল অবস্থা বলে ভাববে না৷                 ২৪ মার্চ ১৯৯০, কলিকাতা