নবপ্রভাতের প্রতিক্ষায়

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

এ বিশ্বের ধন–সম্পত্তির মালিকানা ন্যায়তঃ ব্যষ্টির না সমাজের–এ নিয়ে দার্শনিকদের মধ্যে এখন বিরাট দ্বন্দ্ব৷ ব্যষ্টি মালিকানাবাদীরা বলেন, ব্যষ্টিই যখন কলকারখানা গড়ে তুলছে–শ্রম দিয়ে বুদ্ধি দিয়ে জমি–জায়গা করেছে–তাহলে এতে তার চরম মালিকানা তো সম্পূর্ণ ন্যায়সম্মত সিদ্ধ৷ প্রাউট দর্শন এখানে স্পষ্ট ভাবে বলছে ঃ এ বিশ্বের কোন সম্পদ মানুষ সৃষ্টি করে নি যিনি সমগ্র বিশ্ব সৃষ্টি করেছেন সেই পরম ব্রহ্ম বা ভূমাসত্তাই সব সম্পদের স্রষ্টা–তিনিই প্রকৃত মালিক৷ মানুষ শুধু প্রকৃতিদত্ত সম্পদকে নিয়ে ‘ফিজিক্যাল মিক্সচার’ বা ‘কেমিক্যাল কম্পাউন্ড’ বানিয়েছে বা আকারগত পরিবর্তন করেছে মাত্র৷ তাই কোনও মানুষ এর প্রকৃত মালিক হতে পারে না৷ তবে, সমস্ত মানুষ যেহেতু সেই বিশ্বস্রষ্টা পরমপিতারই সন্তান, তাই বিশ্বের সমস্ত সম্পদে সকল মানুষের পৈত্রিক অধিকার রয়েছে৷ বাঙলার বল্লাল সেনের আমল থেকে চলে আসা জীমূতবাহন ভট্টাচার্য্য প্রণীত দায়ভাগ প্রথায় পিতৃশাসিত একান্নবর্তী পরিবারের মতই এই বিশ্বপরিবারের সমস্ত সম্পদে বিশ্বস্রষ্টার সন্তান হিসেবে সবার যৌথ অধিকার রয়েছে৷ তাই, বিশেষ কোন ব্যষ্টি এ সম্পদ বিপুল পরিমাণে সঞ্চয় করে রাখবে, আর অন্যান্যদের গ্রাসাচ্ছাদনের সম্বলও থাকবে না–এ ব্যবস্থা কোন প্রকারে মেনে নেওয়া যায় না৷ প্রাউট দর্শন তাই পুঁজিবাদের উচ্ছেদ ও প্রগতিশীল সমাজতন্ত্রের প্রবর্ত্তন চায়৷ এই প্রগতিশীল সমাজতন্ত্রের প্রথম শর্ত হ’ল ঃ সমাজে প্রতিটি মানুষের ন্যূনতম চাহিদা পূরণের অর্থাৎ অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান, তথা কর্ম সংস্থাপনের গ্যারান্টি চাই৷ তাই ব্যষ্টির অবাধ সঞ্চয়ের স্থান প্রাউটে নেই৷ বিশ্বের সমস্ত সম্পদের সর্বাধিক উপযোগ ও ন্যায়সঙ্গত বন্টন ব্যবস্থা প্রাউটের মৌলিক অর্থনৈতিক ভিত্তি৷

এখন তাই স্পষ্ট যে প্রাউট ধনতন্ত্রের মত শিক্ষা, কলকারখানা, জমি জায়গা এ সবের ওপর ব্যষ্টির চরম ব্যষ্টিগত মালিকানা স্বীকার করে না৷ প্রাউট বলে–ভূসম্পত্তি, শিল্প, বাণিজ্যের সাধারণীকরণ করতে হবে৷ প্রাউট ‘রাষ্ট্রীকরণের’ কথা বলছে না৷ কেননা সমস্ত সম্পদের রাষ্ট্রীকরণ মানে–‘ষ্টেট ক্যাপিটালিজম’৷

এমনিতে ক্যাপিটালিজম–এ শ্রমিকের শ্রমের উদ্বৃত্ত মূল্য (surplus value) শোষণ করে ক্যাপিটালিষ্টরা৷ ষ্টেট ক্যাপিটালিজমেও এই শ্রমিকের ‘সারপ্লাস ভ্যালু’ শোষণ করা হচ্ছে ও তা করছে ষ্টেট৷ শ্রমিক যেই তিমিরে সেই তিমিরে৷ আর সরকারী শাসন–ক্ষমতায় যারা অধিষ্ঠিত তারাই ভোগ করছে সমস্ত সুখ–সুবিধা৷ যুগোশ্লাভিয়ার প্রাক্তন ভাইস–প্রেসিডেন্ট মিলোভ্যান জিলাস–এর ভাষায়–‘‘‘The communist political bureaucracy uses, enjoys, and disposes of national property’’’৷ তিনি বলেন, কমিউনিষ্ট দেশেও সেই পুঁজিবাদী দেশের মত দুই শ্রেণীর সৃষ্টি হয়েছে–এক দল সুবিধা ভোগী শাসকশ্রেণী •‘‘a new class’’—, অপর দল বঞ্চিত সাধারণ মানুষ৷

তাছাড়া, যে রাষ্ট্রের হাতে অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রনৈতিক দুই প্রকার ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়–তা অত্যাচারী হতে বাধ্য (Abosolute power corrupts abosolutely)৷

আজ যে ভয়ংকর যুদ্ধের রণ দামামা বাজছে পশ্চিমের  আকাশে, বীভৎস হিংস্রতার শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ, অমানবিক নিষ্ঠুরতার হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না অবোধ শিশুও,দাম্ভিক ক্ষমতা লোলুপ রাষ্ট্র নায়কের সর্বগ্রাসী ক্ষুধা বিভীষিকাময় মূর্ত্তিতে প্রকাশ পাচ্ছে, এরও পশ্চাতে আছে পুঁজিবাদী মানসিকতার পরস্ব অপহরণের উদগ্র বাসনা৷ এই বাসনা চরিতার্থ করতেই উন্মত্ত বর্বরতায় ঝাঁপিয়ে পড়েছে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র৷ মারণাস্ত্রে সজ্জিত হয়ে কল্যাণের আদর্শকে উপেক্ষা করে উদ্দাম নিষ্ঠুরতায়,দানবিক মত্ততায়৷ তবে এই দানবিকতাই শেষ কথা নয়৷ কালরাত্রির অবসান ঘটিয়ে সূর্যের উদয় যেমন চিরন্তন সত্য তেমনি, এই দানবীয় বিভীষিকার অবসান ঘটিয়ে যুদ্ধের রণ দামামা থামিয়ে নূতন প্রভাত আসবেই৷