পরিকল্পনার মৌল নীতি

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

যাঁরা বিভিন্ন স্তরে যোজনা পর্ষদের সঙ্গে সংযুক্ত সেই ধরণের বড় বড় অর্থনীতিবিদদের কোন পরিকল্পনা প্রণয়নের আগে যে কয়েকটি বিষয়ের দিকে বিশেষ নজর দেওয়া উচিত সেগুলি হ’ল–

* উৎপাদনের ব্যয়

* উৎপাদন–ক্ষমতা

* ক্রেতার ক্রয়ক্ষমতা  

* সামূহিক প্রয়োজনীয়তা৷

এবার উপরি–উক্ত বিষয়গুলির প্রত্যেকটি নিয়ে আলোচনা করা যাক৷

উৎপাদন–ব্যয়

প্রতি ইউনিট উৎপাদনের যে আসল ব্যয় তা ঠিকভাবে নির্ধারণ করতে গেলে অর্থনীতির এই দিকটাকে নোতুন করে’ পুনর্বিন্যস্ত করতে হবে, ও সমবায় পদ্ধতিতে শিল্পের ক্ষেত্রে যে নীতি অবলম্বন করা হয় সেই নীতিই কৃষির ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করতে হবে৷ প্রাউটের মতে কৃষিকেও সুসংঘটিত শিল্প হিসেবে গণ্য করতে হবে৷

দ্বিতীয়তঃ অর্থনীতির এই দিকটার আরও একটা বৈশিষ্ট্য হ’ল কোন নির্দিষ্ট পণ্যের উৎপাদন–মূল্য তার বাজার–দরের চেয়ে যেন কোনক্রমেই বেশী না পড়ে৷ প্রতিটি অর্থনৈতিক ইউনিট যেন ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে সমর্থনযোগ্য হয়৷

উৎপাদন–ক্ষমতা

অর্থনীতিকে এমনভাবে ঢ়েলে সাজাতে হবে যাতে অর্থনীতি যেন আপন অন্তর্নিহিত শক্তিবলেই অধিকন্তু থেকে অধিকতর উৎপাদন–সামর্থ্য অর্জন করে৷ উৎপাদিত ভোগ্য–পণ্যকে বাজারে বেচে যে টাকা পাওয়া গেল তাকে সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদনে বিনিয়োগ করতে হবে  টাকাকে ফেলে না রেখে সচল রাখতে হবে  ক্রেতার ক্রয়ক্ষমতা, ও সমাজের সামূহিক ধন সম্পদের পরিমাণকে ক্রমবর্ধমান হারে বাড়াতে হবে৷ পরিকল্পনা প্রণয়নকারীরা অর্থনীতিকে এমন ভাবে ঢ়েলে সাজাবেন যে, তাতে সমাজের সামূহিক চাহিদা অনুযায়ী সর্বাধিক উৎপাদন নেওয়া যেতে পারে৷ এর অর্থ হ’ল পূর্ণ বিনিয়োগ নীতি ও উপভোগের লক্ষ্যের ভিত্তিতে বর্ধিত উৎপাদন নীতিকে সমর্থন জানানো৷ এর অনিবার্য ফলশ্রুতি হবে এই যে, এতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা যাবে বেড়ে৷ দ্বিতীয়তঃ, কোন উৎপাদনক্ষম অর্থনৈতিক ইউনিটই বেকার বা অব্যবহূত হয়ে পড়ে থাকবে না৷ তৃতীয়তঃ, যদি পুরো অর্থনৈতিক কাঠামোটার সর্বাধিক উৎপাদন সামর্থ্যকে কাজে লাগানো যায়, তাতে এমন একটা অনুকূল অর্থনৈতিক পরিবেশ গড়ে’ উঠবে, যাতে– বিনিয়োগকারী উৎপাদনের ক্ষেত্রে অধিকতর বিনিয়োগ করতে চাইবেন, ব্যাপকতর শিল্পায়নের পরিবেশ তৈরী হবে, বেশী চাকুরীর সংস্থান হবে, উৎপাদিত সম্পদের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে, মানুষের ক্ষয়ক্ষমতা বেড়ে যাবে, ও বিনিয়োগযোগ্য মূলধনের পরিমাণ বেড়ে যাবে ক্রমবর্দ্ধমান হারে৷

ক্রয়–ক্ষমতা

পরিকল্পনার আরও একটি মৌলিক উদ্দেশ্য হ’ল সমাজের প্রতিটি মানুষের ক্রয়–ক্ষমতা বাড়ানো৷ মানুষের মাথা–পিছু আয়কে এ পর্যন্ত জনসাধারণের অর্থনৈতিক উন্নতির সূচক–যথার্থ মান বলে’ গণ্য করার যে প্রথা প্রচলিত আছে–প্রাউট তা সমর্থন করে না৷ মাথাপিছু আয়ের হিসেবে সমাজের সামূহিক সম্পদের পরিমাণ নির্দ্ধারণ করা একটা বিভ্রান্তিকর, প্রতারণামূলক ও অত্যন্ত ত্রুটিপূর্ণ পদ্ধতি৷ সাধারণ মানুষকে বোকা বানাবার জন্যে, ও শোষণকে জনসমক্ষে ধামাচাপা দেবার জন্যে পুঁজিবাদের তল্পীবাহক অর্থনীতিবিদরা এই তত্ত্বটি জনসাধারণের মধ্যে প্রচার করেছিলেন৷ এ বিষয়ে প্রাউটের সুস্পষ্ট অভিমত হ’ল এই যে, মানুষের যথার্থ অর্থনৈতিক উন্নতির পরিচয় পাওয়া যাবে মানুষের মাথাপিছু আয় দেখে নয়, তার বাস্তবিক ক্রয়–ক্ষমতা দেখে৷ কে কত হাজার টাকা নগদ আয় করল সেটা বড় কথা নয়–আয়ের টাকায় সে কতটা ভোগ্যপণ্য পেল সেটাই বড় কথা৷

জনগণের ক্রয়–ক্ষমতা বাড়াতে গেলে যে কয়েকটি বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে সেগুলি হ’ল ঃ–

(১)     মানুষের সামূহিক প্রয়োজন অনুযায়ী পর্যাপ্ত সামগ্রীর যোগান দিতে হবে৷

(২) ভোগ্যপণ্যের বাজার–দর বেঁধে দিতে হবে৷

(৩)     মুদ্রাস্ফীতিকে রোধ করতে হবে৷

(৪)     ক্রমবর্দ্ধমান হারে মাঝে মাঝে মজুরী ও মাসিক আয়ের পরিমাণ বাড়াতে হবে৷

(৫) সামূহিক সম্পদের পরিমাণ বাড়িয়ে যেতে হবে৷

প্রাউট অর্থনীতিতে মানুষের ক্রয়–ক্ষমতার কোন সর্বোচ্চ সীমা বেঁধে দেওয়া হবে না৷ অর্থাৎ প্রাউট–র্থনীতির রূপায়ণকারীদের দায়িত্বটা থাকবে এই যে, তাঁরা মানুষের ক্রয়–ক্ষমতাকে ক্রমবর্দ্ধমান হারে বাড়িয়েই যাবেন৷ কোন একটা বিশেষ সময়ে মানুষের নূ্যনতম প্রয়োজন অনুযায়ী ক্রয়–ক্ষমতা নির্দিষ্ট করা হবে, তারপর থেকে স্থান–কাল–পাত্রের পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ক্রয়–ক্ষমতাকে উত্তরোত্তর বাড়িয়েই যেতে হবে৷ তাই প্রাউটের লক্ষ্য হ’ল সংশ্লিষ্ট অর্থনৈতিক ইউনিটের আর্থিক উন্নতি অনুযায়ী মানুষের ক্রয়–ক্ষমতা ক্রমবর্ধমান হারে বাড়িয়ে চলা৷

সামূহিক প্রয়োজন

যাঁরা অর্থনৈতিক পরিকল্পনার রূপকার তাঁদের উচিত আজকের মানুষের সামূহিক প্রয়োজনটা কী, আবার ভবিষ্যতের মানুষের প্রয়োজন বা কী হবে, সে সম্বন্ধে একটা স্বচ্ছ ধারণা রাখা৷ তারই পরিপ্রেক্ষিতে তাঁদের অর্থনৈতিক–উন্নয়ন– প্রণয়ন করতে হবে৷২২

যদি যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় কোন একটি বিশেষ সামাজিক–অর্থনৈতিক অঞ্চল অর্থনৈতিক সুবিচার না পায় তাহলে তারা যুক্তরাষ্ট্রীয় বাজেটের মধ্য থেকে তাদের জন্যে পৃথক অর্থভাণ্ডারের ন্দ্রব্ভুস্তুগ্গ দাবীতেআন্দোলন করতে পারে৷ এই আন্দোলন করার পরও যদি তারা সুবিচার না পায় তখন তারা পৃথক রাজ্যের দাবী করতে পারে৷ তবে পৃথক বাজেট ও পৃথক প্রশাসন সমম্বিত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বহু সংখ্যক রাজ্য (বা রাষ্ট্র) গড়ার পক্ষপাতি প্রাউট নয়৷ বহু সংখ্যক রাজ্য (বা রাষ্ট্র) সৃষ্টি হলে সামাজিক–অর্থনৈতিক সমস্যা অনেক বৃদ্ধি পাবে৷ এতে প্রশাসনিক ব্যয় দ্বিগুণ হবে ও অপচয় বাড়বে৷ বরং ছোট ছোট  রাজ্যকে (বা রাষ্ট্রকে) সংযুক্ত করে’ বড় সামাজিক অঞ্চল গড়া বিধেয়৷