পুঁজিবাদ ও সাম্যবাদ (কম্যুনিজম) – এদের মূলগত ত্রুটি

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

সাম্যবাদ ও পুঁজিবাদ মূলতঃ জড়বাদী দর্শন৷ উভয়েই জাগতিক আসক্তির মানসিকতাকে বাড়িয়ে দেয়৷ যার ফলে মানুষ অন্ধভাবে অর্থ, নাম, যশ, ক্ষমতা, প্রতিষ্ঠা ও প্রভাব–প্রতিপত্তির জন্যে ক্ষ্যাপা কুকুরের মত ছুটে চলে৷

জড়বস্তুকে পাওয়ার সীমাহীন এষণাই পুঁজিবাদের জন্ম দিয়েছে৷ জমি–জমা, টাকা–পয়সা, ধাতব–ধাতব পণ্যসামগ্রী–এইসব জড়–জাগতিক ধনসম্পদ আহরণের মনস্তত্বই পুঁজিবাদের প্রধান কারণ৷ পুঁজিবাদে এই ধরণের স্থূল–মানসিক ক্ষুধা ও মানসিক–আভোগ থেকে যায় বলে’ তা মানুষকে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এক বুভুক্ষু লোভী জীবে পরিণত করে৷ ফলস্বরূপ, ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা যেন–তেন–প্রকারেণ অধিক থেকে অধিকতর ভৌতিক সম্পদ সঞ্চয়ের মানসিক রোগে ভুগতে শুরু করে৷ এমনকি সাধারণ মানুষকে তাদের জীবনের নূ্যনতম প্রয়োজনীয় জিনিস থেকেও বঞ্চিত করতে দ্বিধা বোধ করে না৷ ওই ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা বৈষয়িক লাভের জন্যে মানসিক ক্ষুধা অথবা মানস–আভোগ–তৃপ্তি নিয়ে হন্যে কুকুরের মত ছুটে বেড়ায়, ও অপরকে নির্মমভাবে শোষণ করতে দ্বিধাবোধ করে না৷ শোষকেরা এই মৌলিক সত্যটা ভুলে যায় যে, এই জগতের ভৌতিক সম্পদরাজি অত্যন্ত সীমিত, কিন্তু মানসিক আভোগ এক অন্তহীন মানস–এষণার দ্বারা পরিচালিত৷ ফলে মুষ্টিমেয় মানুষ হয়ে ওঠে পুঁজিবাদী, ও বাকীরা শোষিত দরিদ্রে পরিণত হয়৷ এই বৈশ্য শোষণের সূত্রপাত নিহিত আছে জাগতিক বস্তু সঞ্চয়ের তৃপ্তিহীন ক্ষুধার মধ্যে৷ শোষণের এই অনিয়ন্ত্রিত অতৃপ্ত মানসিক ক্ষুধা মানুষের মৌল মানবিক–মূল্যকে অস্বীকার করে, ও বিভিন্ন ধ্বংসাত্মক ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে তা আত্মপ্রকাশ করে৷ এই অতৃপ্ত মানসিক এষণা ও আভোগই শেষ পর্যন্ত পুঁজিবাদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়৷ পুঁজিবাদ হ’ল মানবতাবিরোধী৷ পুঁজিবাদে ব্যাপক বেকার–সমস্যা, নৈতিক অবক্ষয়, সাংসৃক্তিক বিকৃতি, সামাজিক ভেদ–বিভেদ, অর্থনৈতিক অস্থিরতা, রাজনৈতিক উচ্ছৃঙ্খলতা, উপধর্মীয় ভাবজড়তা ও মানবতার অবমূল্যায়ন দেখা যায়৷ সমাজকে এই বৈশ্য–শোষণের হাত থেকে মুক্ত করতে হলে পুঁজিবাদকে সমাজ থেকে নির্মূল করতে হবে৷ এর জন্যে মানসাধ্যাত্মিক প্রক্রিয়ার সাহায্যে বল্গাহীন মানসিক এষণা ও আভোগকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে৷

কম্যুনিজম হ’ল জড়বাদের ওপর আধারিত এক সামাজিক–র্থনৈতিক– সিদ্ধান্ত৷ সাম্যবাদী সমাজের মানুষের মানসিক এষণা বা আভোগ জড়–সম্পদের আহরণ তথা স্থূল জড়ভোগের পেছনে ছুটে বেড়ায়৷ যখন মানুষের মানসিক আভোগ স্বভাবগতভাবে এই জড়বাদী ভাবধারায় পরিচালিত হয়, তখন তার মধ্যে অমানবোচিত ঋণাত্মক আচরণ ফুটে ওঠে৷ সেক্ষেত্রে তারা জীবনধারায় বহির্মুখী হয়ে পড়ে, জাগতিক সম্পদের প্রতি প্রবল আসক্ত হয়ে পড়ে, অপরের চিন্তা বা মতবাদের প্রতি উগ্র অসহিষ্ণুতার পরিচয় দেয়, বিরোধী পক্ষকে দমন করার জন্যে পাশবিক শক্তি প্রয়োগ করে, আধ্যাত্মিকতাকে অস্বীকার করে৷ তথাকথিত সাম্যবাদী–সমাজে এই অবগুণগুলি পুরোমাত্রায় রয়েছে৷ যেহেতু সাম্যবাদী–সমাজে আধ্যাত্মিকতার কোন স্থান নেই, মন আধ্যাত্মিকতাকে তার মানস–আভোগ করে’ নিতে পারে না বলে’ জড়বস্তুর দিকে ধাবিত হয়৷ তখন অর্থ, বিষয়–সম্পদ, ক্ষমতা ও ভোগলিপ্সাই মানুষের জীবনের সারকথা হয়ে দাঁড়ায়৷ ফলতঃ মানসিক আভোগ তখন জাগতিক সুখ–ভোগের পানেই ছুটে যায়৷ সমাধানের নামে সাম্যবাদী দেশে শাসকগোষ্ঠী বেপরোয়াভাবে পাশবিক শক্তি প্রয়োগে মানুষের জাগতিক ক্ষুধাকে অবদমন করে–যা অত্যন্ত ত্রুটিপূর্ণ ও যুক্তিহীন৷ এই অবস্থায় জড়বাদী সাম্যবাদ শোচনীয়ভাবে ত্রিবিধ বন্ধনে বাঁধা পড়ে যায়৷ প্রথমটি হ’ল সমবণ্ঢনের ত্রুটিপূর্ণ আদর্শ দ্বিতীয়তঃ, সাম্যবাদী দেশে বল্গাহীন মানসিক আভোগ থেকে জন্ম নেয় একটা অপ্রতিরোধ্য জড়াভিমুখী প্রবণতা তৃতীয়তঃ, সেই অপ্রতিরোধ্য জড়াভিমুখী প্রবণতাকে অবদমিত করার জন্যে একচ্ছত্র কম্যুনিষ্ট রাষ্ট্রের একটা অক্ষম প্রয়াস বলবৎ থাকে৷ কিন্তু এই মানসিক এষণা ও আভোগকে পশুশক্তি প্রয়োগে কখনই লৌহ–যবনিকার অন্তরালে অবদমিত করে’ রাখা যায় না৷ মানুষের মন সমস্ত বৃত্তির সহায়তায় এক প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তির উৎসারণ ঘটায়–যার অবাধ অভিব্যক্তির তথা অভিপ্রকাশের জন্যে অনুকূল পরিবেশ অত্যাবশ্যক৷ বর্ত্তমান সাম্যবাদী শাসন–ব্যবস্থায় বিভিন্ন মানসিক আভোগের এই প্রেষণা অবৈজ্ঞানিক ও অমনস্তাত্বিক ভাবে দমিত হচ্ছে৷

 মানুষকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে কম্যুনিষ্ট রাষ্ট্র পীড়নমূলক বিধিব্যবস্থা, সামাজিক বয়কট, বহিষ্ক্রণ, অনির্দিষ্টকালের জন্যে অন্তরীণ রাখা, সামাজিক নিপীড়ন, সামাজিক–র্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চনা–এমনি নানান রকম উপায় অবলম্বন করে’ চলেছে৷ এমনই ত্রুটিপূর্ণ সমাজ–ব্যবস্থায় মানুষ তার জীবনের গতিময়তা হারিয়ে ফেলে, তার কল্পনাশক্তি নষ্ট হয়ে যায়, ও কর্মৈষণা দুর্বল হয়ে পড়ে৷ এই ভাবে জড়–সাম্যবাদী সমাজ এক বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে পড়ে’ যায়, ও সাম্যবাদের পতনকে ত্বরান্বিত করে৷ এই বিশৃঙ্খলাবস্থা আরো চরম নৈরাজ্যের দিকে ঠেলে দেয়, ও দানবের রাজত্বে পরিণত করে৷ আজ সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা এমনই এক অবশ্যম্ভাবী বেদনাদায়ক পরিণতির দিকে এগিয়ে চলেছে৷

মানসিক আকুতি বিষয়মুখী হলে চলবে না, বা তাদের অবদমন ঠিক নয়৷ বরং যথার্থ মানসাধ্যাত্মিক সাধনার দ্বারা তাদের পরম লক্ষ্যের দিকে প্রধাবিত করতে হবে৷ পরমসত্তা সর্বদা একই–সেখানে দ্বৈত–র কোন স্থান নেই৷ মানসাধ্যাত্মিক সাধনার ক্ষেত্রে সহস্রবৃত্তিযুক্ত মন এক বিন্দুস্থ হয়ে পরম একক সত্তার পানে ধাবমান হয়৷ সহজ কথায়, মানসাধ্যাত্মিক উন্নতির উচ্চাবস্থাতে মনের এষণা তথা মনের সমুদয় আভোগ এগিয়ে চলে এক মানসাধ্যাত্মিক আভোগের দিকে, ও শেষ পর্যন্ত তা এক ভূমা–চৈতন্যে মিলিত হয়৷ এই অভ্যন্তরীণ প্রবাহ তথা মানসাধ্যাত্মিক আভোগের এক বিন্দুমুখী রূপান্তরণ বৈয়ষ্টিক জীবনে ও সমাজ সংরচনায় এক সার্বিক পরিবর্ত্তন সংঘটিত করে’ মানুষকে করে’ তোলে গভীর ভাগে অন্তর্মুখী, অধ্যাত্মবাদী ও অর্ন্তলীন৷ বস্তুজগতের সঙ্গে পারমার্থিক জগতের সন্তুলন ঘটিয়ে সে তখন হয় শান্ত, সংযত ও জড়ভোগের প্রতি নিরাসক্ত৷ শুধু তাই নয়, মানুষ তখন কঠোর হয়েও নীতিবাদী, বিপ্লবী কিন্তু ভক্ত, কর্মচঞ্চল কিন্তু আত্মসংযমী, ঐতিহ্যবাহক কিন্তু প্রগতিশীল ও সম–সমাজতত্ত্বের প্রতিপালনে কঠোর ভাবে তৎপর, সামাজিক ক্ষেত্রে আরও সামাজিক, বন্ধুত্বপূর্ণ, সহায়ক ও উদার হয়ে ব্যষ্টিগত ও দলগত বিবাদের নিষ্পত্তি ঘটায়  সামাজিক সমতা, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, রাজনৈতিক স্থায়িত্ব, সাংসৃক্তিক নবজাগরণ ও সার্বিক মানবমুক্তির ওপর নির্ভর করে’ সমাজকে পুঁজিবাদের দাসত্ব ও সাম্যবাদের অবদমন থেকে মুক্ত করে’ নব্যমানবতাবাদের গৌরবে প্রতিষ্ঠিত করে৷