সামাজিক মূল্য ও মানবিক মৌল নীতি

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

সুদুর অতীত থেকে একে একে বিবর্তনের ধাপ পেরিয়ে নামুষ আজকের এই পরিবেশে এসে পৌঁছেছে৷ তার এই অবিরল যাত্রা কিন্তু একক নিঃসঙ্গ যাত্রা নয়৷ সে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে তার সমাজকেও৷ অতীতের সেই অবিকশিত অনুন্নত অবস্থাতেও মানুষ বাস করত বিভিন্ন গোষ্ঠীতে দলবদ্ধ  হয়ে৷ এর কারণ, মানুষ পারে না একা বাস করতে পারে না তার দৈনন্দিন জীবনযাত্রার খোরাক সংগ্রহ করতে৷ সমষ্টি ব্যতিরেকে ব্যষ্টির অস্তিত্ব রক্ষা করা অসম্ভব কারণ মানুষ এক সামাজিক জীব৷ মানুষের কথা ভাবতে গেলে স্বভাবতই তার সমাজও এসে পড়ে, তাই মানুষের অস্তিত্বের দু’টি দিক---একটা সে নিজে তার ব্যষ্টির অস্তিত্ব আর দ্বিতীয়টি হ’ল সে সমাজের সদস্য---তার সমষ্টিগত অস্তিত্ব৷ এই দুই অস্তিত্ব থেকে মানুষের মূল্য নির্ধারণ করতে হয়৷ একটি হ’ল তার সামাজিক মূল্য আর অপরটি হ’ল তার মানবিক মূল্য৷

মানুষের সামাজিক মূল্য নির্ধারিত হয় তার সামাজিক দায়িত্ব থেকে৷ সমাজের সদস্য হিসেবে তাকে বিশেষ কতকগুলি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে হয়৷ যে ড় দায়িত্ব পালন করে মানুষ স্বভাবতই তাকে মেনে নেয়---শ্রদ্ধা করে৷ কারণ এই দায়িত্ব পালনের মধ্যেই সকলের কল্যাণের প্রসঃ জড়িয়ে থাকে৷ ইতিহাসের পর্যালোচনা করলে দেখতে পাই পৃথিবীতে যেদিন ক্ষত্রিয় যুগ ছিল, সেদিন অন্যান্য শ্রেণী থেকে রাজ-রাজারা পেত সব থেকে বেশী সম্মান৷ রাজদরবারে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা জনসাধারণ কুর্নিশ করত বাদশাকে সম্মান প্রদর্শন ক’রত বিনা দ্বিধায়৷ কারণ সেই ক্ষত্রিয়েরা তাদের বীরত্বে, সাহসে, শৌর্যের মহিমায় মানুষের মনে এক আসন করে নিয়েছিল৷ ঠিক তেমনি বিপ্রযুগে আমরা দেখতে পাই প্রয়ুগে আমরা দেখতে পাহ দ্ধিজীবীদের পায়ের তলে লুটিয়ে পড়েছে ক্ষত্রিয় ও অন্যান্য শ্রেণীর মানুষ৷ কারণ বিপ্রদের দ্ধির প্রাখর্যে অভিভূত হয়ে গিয়েছিল সবাই৷ এই বিপ্রেরা আবিষ্কার করেছিল মানুষের কল্যাণের বিভিন্ন সামগ্রী তাদের ৌেদ্ধিক গবেষণায় সাধারণ মানুষ উপকৃত হয়েছিল লেই সাই তাদের মেনে নিয়েছিল ঋষি লে৷ ভক্তিশ্রদ্ধায় নত হয়ে আসত সবার মস্তক সেই মহান ঋষিদের চরণে৷ এই হ’ল স্বাভাবিক নিয়ম---মানুষ সর্বদা সামাজিক মূল্যকেই সম্মান করে’ এসেছে সর্বদেশে সর্বকালে, কিন্তু মানবিক মূল্যকে কেউ কখনও শ্রদ্ধা করেনি৷ দেয়নি কেউই মানুষের মনুষ্যত্বকে সম্মান৷

মানবিক মৌল সিদ্ধান্ত বা Human cardinal principle হ’লa silver lining between the psycho-spiritual and spiritual strata of human existence আধ্যাত্মিক স্তর ও মানসাধ্যাত্মিক স্তর---এই দু’য়ের যে মিলনক্ষেত্র তাকেই লি মৌল মানবিক স্তর৷ মানুষের অস্তিত্ব ত্রিমুখী, ত্রিধারা সমন্বিত---দৈহিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক৷ এই ত্রিমুখী অস্তিত্বের মধ্যে দৈহিক ক্ষেত্রের সীমা অনেকে পেরিয়ে উঠতে পারে না৷ স্থূল ভোগই তাদের একমাত্র ধ্যেয় হয়ে পড়ে৷ তাদের ল দানব বা পশু শ্রেণীভুক্ত৷ নিজেদের  জৈব বৃত্তিরা তাড়নায় তারা সর্বদা প্রেষিত হয়৷ জীবনের সূক্ষ্ম অনুভূতি, সূক্ষ্ম অভিব্যক্তি, সূক্ষ্ম অনুশীলন তাদের নাগালের বাইরে৷ তারা জানে শুধু তাদের দেহকে, দৈহিক প্রয়োজসমূহকে৷

আবার অনেকে রয়েছেন যাঁরা শুধু দেহ নয়, মন নিয়েও তাঁদের কার্রার৷ তাঁরা অনুভব করেন যে মনের প্রাধান্যই পশুদের থেকে তাঁদের পৃথক করেছে৷ মানসিক পরিতৃপ্তির এষণায় তাঁদের জীবনধারা নিয়ন্ত্রিত৷ সূক্ষ্ম অনুশীলনের প্রচেষ্টায় তাঁরাই সৃষ্টি করেন কাব্য, কবিতা, শিল্প, সঙ্গীত, ভাস্কর্য৷ দয়া, মমতা, প্রেম, মৈত্রী, করুণা নিয়ে তাঁদের জীবনাভিব্যক্তি৷ তাঁরা উপলব্ধি করেন যে মনের গতিধারা অনন্তের সাথে মিলনের জন্যেই প্রবাহিত, তাই তাঁদের সমস্ত শক্তিকে তাঁরা নিয়োজিত করেছেন পরমসুন্দরের ধ্যানে৷ বৈবহারিক জীবনে তাঁরা আধ্যাত্মিক সাধক৷ এঁদেরই ল মানব৷

এই আধ্যাত্মিক সাধক পরমপুরুষের তীব্র বেগে চলতে চলতে একদিন এসে পৌঁছান এমন এক স্থানে যেখানে মানসিক সত্ত্বার শেষ ও আধ্যাত্মিকতার শুরু৷ সে সময় তাঁকে আর সাধারণ মানুষের পর্যায়ে ফেলতে পারি না৷ তাঁকে তখন ল দেবতা৷ মানবাস্তিত্বের  এই যে  পরিণতি  যেখানে  মানসিক  স্তর আধ্যাত্মিক স্তর--- দু’য়ের  হয় সংযুক্তি, সেই অবস্থায়  পৌঁছানো প্রত্যেকটি  মানুষের  কাম্য ও কর্তব্য৷ মানবতার  চরম উন্নতি  এখানেই৷  এরপর  আর মানবতা  থাকে না, থাকে  শুধু  দেবত্বের  মহিমা৷  যেখানে পশুতার  পরিসমাপ্তি , সেখানে  থেকে শুরু  হয় মানবতার  যাত্রা৷ আর  মানবতার  চরম শিখরে  উন্নয়নের  পরই  শুরু  হয় দেবত্বের  পরমা প্রশান্তি৷   Where animality ends humanity begins, where humanity culminates divinity starts. এই মানবতার  চরম বিকাশ  ও দেবত্বের  প্রারম্ভ  ও  দু’য়ের  যে সন্ধি পর্যায়  তারই ওপর ভিত্তি  করে মানবিক  মৌল নীতি  নির্র্ধরিত হয়৷

অতীত থেকে বর্তমান  পর্যন্ত  মানবজাতির  ইতিহাসের  দিকে  দৃষ্টিপাত করলে  আমরা দের্খ  যে কোথাও  মানবিক মূল্য সম্মানিত  হয়নি৷  সম্মান  তো  দূরের  কথা মনুষ্যত্বের দিকে  কেউ  দাক্ষিণ্যের    দৃষ্টিপাত পর্যন্ত  করে নি৷ মানুষ  শ্রদ্ধা  করেছে তাদের  যার  দ্বারা  তার স্বার্থপূর্তি  হতে পারে৷  ভূলুন্ঠিত  মানবতাকে অবহেলা করে  করে’  তারা সম্মান করেছে  তাদের,  যারা  সমাজের  উচ্চমঞ্চে  প্রতিষ্ঠিত৷  এই উচ্চ মঞ্চের  অহঙ্কার  থেকে  নীচে  নেমে  এসে মাটির  মানুষের সাথে  যোগাযোগ  রক্ষা  করায়  অনেক াধা৷ মানুষের  অবহেলা  আরও তীব্রভাবে  প্রকট হয়েছে  প্রতিটি  যুগের  শেষ অধ্যায়ে৷ মহান   ক্ষত্রিয়দের সন্তানেরা, যাঁরা  বংশপরম্পরাক্রমে  রাজসিংহাসনে  অধিকার  ভোগ  করতেন,  তাঁরা নিজেদের  প্রজাপালনের  কর্তব্যটুকু বিস্মৃত  হয়ে,  মানুষের  কল্যাণের  পবিত্র   দায়িত্বটুকু কে  ভুলে  গিয়ে নিজেদের  বিলাস ব্যসনের  উপাচার  সংগ্রহে  ব্যস্ত  থেকেছেন  সারাক্ষণ৷ নিপীড়িত মানুষের  জীবনের টুকিটাকির  খর  তাঁরা  কখনও  নেননি৷  দারিদ্র্যের যাতনায়  হয়ত  ওষ্ঠাগত  প্রাণ, কিন্তু  রাজকর  না দেওয়ার  অপরাধে  অধস্তন  কর্মচারীর  বেতের  আঘাতে  ক্ষতবিক্ষত  হয়েছে  বৃদ্ধ  প্রজার  দুর্বল  জীর্ণ শরীরগাত্র৷ দয়ালু  ও মানবপ্রেমিক  রাজা  যে ছিলেন  না তা নয়৷  কিন্তু  এমন রাজা  কোথায় যিনি  সমস্ত  মানুষের দৈহিক  ও মানসিক  ক্ষুধা  পরিতৃপ্ত  করে প্রজ্ঞাঘন  সত্তার  সঙ্গে   মহামিলনের  আয়োজন  করে দিয়েছেন? নিজেদের? নিজেদের  প্রতিষ্ঠা  ও বিশ্বজয়ের অপ্রতিরোধ্য বাসনায় তাঁরা  রণ-অভিযান  করেছেন  দেশ থেকে দেশান্তরে৷ সাধারণ মানুষের  হাসি কান্নার  খোঁজ  খর  রাখার  সময় কই  তাঁদের৷ (ক্রমশঃ)