শোষণের বহুবিধ রূপ

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

লোকে প্রায়ই বলে থাকে যে বিশেষ কোনো ব্যষ্টি অথবা বিশেষ কোনো সম্প্রদায়ের লোকেরা ভীষণভাবে শোষিত হচ্ছে৷ শোষণ বলতে তারা এটাই ক্ষোঝে যে এইসব লোকেরা অর্থনৈতিক  স্তরে শোষিত হচ্ছে৷ কিন্তু যদি আমরা এই বিষয়টির গভীরে প্রবেশ করি তাহলে আমরা উপলব্ধি করব যে শোষণ শুধুমাত্র অর্থনৈতিক স্তরেই সংঘটিত হচ্ছে না, মানবাস্তিত্বের অন্যান্য স্তরেও বিভিন্ন রূপে বিচিত্র ভাবে তার অস্তিত্ব রয়েছে৷ যখন আধিভৌতিক স্তরে (physical stratum) শোষণ হয় তখন সেটা যে সব ক্ষেত্রেই অর্থনৈতিক হবে এমন নয় এটা প্রায়ই সামাজিক ও অনেক ক্ষেত্রে অপ্রত্যক্ষভাবে সামাজিক হয়ে থাকে৷ দৃষ্টান্ত–স্বরূপ বলা যায় কায়েমী স্বার্থবাহকেরা কোনো একটা পর্যায়ে জনমানসে গূড়ৈষ (complex) ঢুকিয়ে দেয় ও বেশ কিছুকাল পরে তারা সেই অবদমিত জনমানসকে শোষণ করে৷ সেই সময়ে শোষণ অর্থনৈতিক না হয়ে আধিভৌতিকও  (physical) হতে পারে৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই আধিভৌতিক শোষণ অর্থনৈতিক শোষণে পর্যবসিত হয় সেটা এর চেয়ে ভাল বা খারাপ যাই হোক না কেন৷

মানসিক স্তরের শোষণ বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই প্রথম পর্যায়ে ভাবজড়তার (dogma) মাধ্যমে সংঘটিত বা সঞ্চারিত হয়৷ এই ভাবজড়তাগুলি অর্থনৈতিক শোষণ বা সামাজিক শোষণের সূত্রপাত করে৷ কখনো কখনো কিছু ধরনের ভাবজড়তার মাধ্যমে আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রেও শোষণ চালানো হয়৷ আধিভৌতিক স্তরের মতই আধ্যাত্মিক স্তরে শোষকেরা ভাবজড়তা দিয়ে প্রথমে লোকের মনে হীনমন্যতা বা মহাম্মন্যতা সৃষ্টি করে ও পরে অর্থনৈতিক বা সামাজিক শোষণ কায়েম করে৷ যখন আধিভৌতিক স্তরে শোষণ চরিত্রগতভাবে অর্থনৈতিক হয় তখন সাধারণ লোকেও সেটা ধরে ফেলে ও সেটাকে বুঝতে তাদের কোনো কষ্ট করতে হয় না৷ এর কারণ অর্থনৈতিক শোষণের ক্ষেত্রে শোষিত জনসাধারণ সহজেই বুঝে যায় কারা তাদের শোষক৷ কিন্তু অন্যান্য সামাজিক ক্ষেত্রে শোষিত জনসাধারণেরা তারা যে শোষিত হচ্ছে সে ব্যাপারে মোটেই সচেতন নয়৷ এই জন্যই সামাজিক ক্ষেত্রে তাদের শোষণ করা খুবই সহজ৷ তাই দীর্ঘদিন ধরে যদি তাদের নিজেদের শাসনাধীন রাখতে ও শোষণ চালিয়ে যেতে চাও তাহলে তাদের মনে হীনমন্যতা সৃষ্টি করে দাও ধূর্ত্ত শোষকেরা এটা খুব সহজেই করে থাকে৷ আর ট্র্যাজেডিটা হচ্ছে যে শোষিত জনসাধারণ এটা নোঝার চেষ্টা করে না–তারা বুঝতে পারে না, এমনকি তারা বুঝতে চায় না যে তারা শোষণের শিকার৷ সেই জন্যই এটা আরও বেশী মারাত্মক৷

যখন অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষভাবে শোষণ চলে তখন সেটা জনসাধারণ সহজেই ধরে ফেলে৷ কিন্তু যখন সামাজিক–অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কিংবা মানস–অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে শোষণ গেড়ে বসে তখন পরিস্থিতি জটিল হয়ে যায়৷ সামাজিক–অর্থনৈতিক শোষণের ক্ষেত্রে জনগণ সামাজিক শোষণের বিরুদ্ধে কিছুটা সরব হয় বটে কিন্তু অর্থনৈতিক শোষণটাকে চিনে নিতে ব্যর্থ হয় যা কিনা সামাজিক–অর্থনৈতিক শোষণের শেষ পরিণতি৷ আর, মানস–অর্থনৈতিক শোষণের ক্ষেত্রে জনসাধারণ মনস্তাত্বিক অবদমনে কিছুটা ক্ষুব্ধ হলেও এর অন্তিম ফল যে অর্থনৈতিক শোষণ সেটা বুঝতে পারে না৷

বর্ত্তমানে সারা পৃথিবীতে জনসাধারণের অর্থনৈতিক সচেতনতা আগের চাইতে অনেক বেশী বৃদ্ধি পেয়েছে৷ আর সেই জন্যেই ধূর্ত্ত শোষকেরা হয় সামাজিক–অর্থনৈতিক, না হয় মানস–অর্থনৈতিক শোষণের পথ অবলম্বন করেছে৷ শোষকেরা বিপুল লাভের ফসল ঘরে তুলতে বিশ্বময় জাল বিছিয়ে রেখেছে৷   এখানে এইসব নিয়ে আর বিস্তারিত আলোচনা করব না কারণ আসলে ভবিষ্যতে আমি এই বিষয়ে একটা বই লিখব ভেবেছি৷ ঙ্মপরবর্ত্তীকালে শ্রী পি.আর.সরকার ‘বুদ্ধির মুক্তি–নব্যমানবতাবাদ’ নামে একটি বই লিখেছেন৷ক্ষ

মানসিক ক্ষেত্রের ব্যাপারে আমি এটা বলতে পারি যে মনস্তাত্ত্বিক স্তরে অজস্র প্রকারের শোষণ হতে পারে৷ আর এগুলিকে অনুধাবন করতে হলে জনসাধারণকে আরও বেশী শিক্ষিত হতে হবে ও আরও বেশী বুদ্ধিমান হতে হবে৷ সামাজিক ক্ষেত্রে শোষকেরা ইচ্ছাকৃতভাবে শোষণের মনস্তাত্ত্বিক স্তরকে আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে গুলিয়ে দেয় ও দীর্ঘস্থায়ী শোষণের পথ মসৃণ করে৷ এই ভাবেই অতীতে ভাবজড়তা এসেছিল আর আজও এই ভাবজড়তাকে এইভাবে কাজে লাগানো হচ্ছে৷ আনন্দমার্গই সর্বপ্রথম ভাবজড়তার বিরুদ্ধে শুদ্ধ আধ্যাত্মিকা প্রতিষ্ঠা করতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে৷ যারা এ পর্যন্ত ভাবজড়তার ওপরেই ভর দিয়ে বেঁচে আছে তারা আনন্দমার্গের বিরুদ্ধে প্রবল সরগোল তুলেছে৷ তারা বুঝতে পারছে যে তাদের শোষণের দিন সমাপ্ত হয়ে গেছে৷ জনগণ আর মুর্খের স্বর্গে বাস করতে রাজী নয়৷ যতদিন পর্যন্ত সাধারণ মানুষ ভাবজড়তার বিরুদ্ধে মাথা তুলতে না শিখছে ততদিন পর্যন্ত প্রকৃত আধ্যাত্মিকতা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে না৷ একদিকে বলা হচ্ছে ‘‘বিজ্ঞানের যেখানে শেষ, দর্শনের সেখানে শুরু’’, আবার অন্যদিকে বলা হচ্ছে ‘‘দর্শনের যেখানে শেষ, বিশ্বাসের সেখানে শুরু’’৷ এটা একেবারেই বাজে কথা৷ মানুষের মহার্ঘ সম্পদ হচ্ছে তার বুদ্ধি৷ যখন মানুষকে যুক্তিতর্কের রাস্তা থেকে সরে আসতে উপদেশ দেওয়া হয় তখন তার অর্থ হয় এটাই যে কায়েমী স্বার্থবাদীরা ভাবজড়তার বিরুদ্ধে সংগ্রামরত মানব মনীষাকে কিনে ফেলতে উঠেপড়ে লেগেছে৷

‘‘এটা কোরো না, করলে পাপ হবে’’ বললেই চলবে না৷ যদি তুমি বল ‘‘এটা কোরো না’’ তবে তোমাকে বলতে হবে এটা কেন করা উচিত নয়৷ সেইরকম ভাবে যদি তুমি বল ‘‘এটা কর’’ তা হ’লে তোমাকে বলতে হবে, কেন করতে হবে৷ বুদ্ধির মুক্তির জন্যে আন্দোলন, বুদ্ধির মুক্তির জন্য প্রচেষ্টা করার মাধ্যমে মানুষ আধ্যাত্মিকতায় প্রতিষ্ঠিত হয়৷ এই প্রচেষ্টায় ঘাটতি থাকলে মানুষ, ধর্মান্ধে পরিণত হয় আর তার ফল হয় ধর্মের নামে দাঙ্গা–হাঙ্গামা করা৷

আমি ইতোপূর্বে বলেছি যে আধ্যাত্মিকতাকে ভাবজড়তার নাগপাশ থেকে মুক্ত করার প্রথম আন্দোলন হচ্ছে আনন্দমার্গ৷ কাজেই তোমরা কোনোমতেই ভাবজড়তাকে প্রশ্রয় দেবে না৷ বরঞ্চ তোমরা ভাবজড়তার বিরুদ্ধে অন্তহীন সংগ্রাম চালিয়ে যাবে৷ আর, যখন তোমরা ভাবজড়তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালাতে থাকবে তখনই তোমরা সত্যের প্রকৃত রূপ উপলব্ধি করতে পারবে৷ সত্যের সংস্পর্শে এলেই তোমরা প্রকৃত আধ্যাত্মিকতায় প্রতিষ্ঠিত হবে৷ মনে রেখো, প্রকৃত আধ্যাত্মিকতায় তোমাদের প্রতিষ্ঠিত হতেই হবে৷ কারণ একমাত্র আধ্যাত্মিকতাতেই মানবজীবনের চরম সার্থকতা ও প্রাপ্তি নিহিত রয়েছে৷ নতুবা, মানুষ ও পশুতে প্রভেদ তো সামান্যই৷ মানুষ যে পশু নয় এটা চরম সত্য ও বাস্তব৷ সেইজন্য মানুষকে মানবজীবনের চরম উৎকৃষ্টতায় প্রতিষ্ঠিত হতেই হবে আর (সেইজন্য) ভাবজড়তার বিরুদ্ধে বিরামহীন সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে৷

আধ্যাত্মবাদীরা যারা আধ্যাত্মিকতাকে ভালবাসে, যাদের এতে সত্যকারের আগ্রহ আছে ও যারা প্রকৃত মানবতার পথে চলতে ইচ্ছুক তাদের অচল হয়ে বসে থাকলে চলবে না৷ নিষ্ক্রিয় হলে চলবে না৷ বরং তাদের খুবই সক্রিয়, উৎসাহী ও কর্মদক্ষ হতে হবে৷ কর্মযোগী না হলে ভক্তিযোগে প্রতিষ্ঠিত হওয়া যায় না, ভক্তিযোগী হওয়া যায় না৷ আর ভক্তিযোগে প্রতিষ্ঠিত হতে না পারলে, প্রকৃত ভক্তিযোগী হতে না পারলে পরমপুরুষের নিকটতম সান্নিধ্য পাওয়া যায় না৷

১৯ আগস্ট ১৯৮০, কলিকাতা