বাঙলার অর্থনৈতিক উন্নয়ন

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

বাঙালী নামধেয় জনগোষ্ঠী হঠাৎ জেগে ওঠা, নোতুন একটা বাউন্ডারী পাওয়া রাষ্ট্রকেন্দ্রিক জনগোষ্ঠী নয়৷ এর রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভাঙ্গাগড়া অনেকবার হয়েছে, কিন্তু জনগোষ্ঠীটা অনেকদিনের৷ বর্তমান বাঙালী নামধেয় জনগোষ্ঠীর বয়স তিন হাজার বছরের চেয়ে বেশী৷

আর অনেকদিনের পুরোণো বলেই এর ঐতিহাসিক অগ্রগতি হয়েছে ধাপে ধাপে৷ সে অনেক কিছু অনেকের থেকে নিয়েছে, অনেক কিছু অনেককে দিয়েছেও৷ যে জন্যে তার নিজস্ব পোষাক রয়েছে, মেয়েদের শাড়ী পরবার নিজস্ব পদ্ধতি রয়েছে, তার নিজস্ব পঞ্জিকা রয়েছে, ভাষা রয়েছে, লিপি রয়েছে, উচ্চারণ রীতি রয়েছে, একটা বিশেষ ধরণের সামাজিকতা রয়েছে, নিজের দায়াধিকারও রয়েছে৷ এতগুলি বৈশিষ্ট্য, আমি যতদূর জানি, পৃথিবীর আর কোন জনগোষ্ঠীর নেই৷ যে মানেতে নেশন শব্দ ব্যবহার হয়, সে মানেতে এই জনগোষ্ঠী নেশনের বাড়তি আরও কিছু৷

রাৰা–সমতট–বরেন্দ্র্–এই পাঁচটি ক্ষেত্র নিয়ে যে সামাজিক অর্থনৈতিক অঞ্চল, বাঙলার সেই সমস্ত অঞ্চলকে আবার এক করতে হবে৷ বাঙলায় আজ একতাবোধের প্রয়োজন সব থেকে বেশী৷ এই একতাবোধ জেগে উঠলেই ভাঙ্গা–বাঙলা আবার জোড়া লাগবে৷ ভাঙ্গা–বাঙলা জোড়া দিতে হলে বাঙলাদেশের জনগণের জীবনযাত্রার মান বাড়াবার উদ্দেশ্যে বাঙলাদেশে উন্নয়নমূলক কর্মসূচী নিতে হবে৷ এপার বাঙলার অর্থনৈতিক মান তো বাড়াতেই হবে, কিন্তু তার থেকেও অনেক বেশী দ্রুতগতিতে বাড়াতে হবে ওপার বাঙলার অর্থনৈতিক উন্নতির মান৷ পশ্চিম বাংলা, ত্রিপুরা ও বাঙলাদেশের আর্থিক অবস্থা যখন সমপর্যায়ে আসবে, কেবল তখনই সংযুক্ত* করা উচিত হবে৷৪৬

আমাদের এই বাঙলার প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী নাম হচ্ছে গৌড় দেশ৷ এককালে এই দেশ গুড় উৎপাদনে সারা বিশ্বে প্রসিদ্ধি অর্জন করেছিল বলে’ একে গৌড় দেশ নাম দেওয়া হয়েছিল৷ আমাদের এই গৌড় দেশকে সামগ্রিকভাবে ‘বাঙালীস্তান’* বলা যেতে পারে৷ কারণ যে অর্থে তামিলনাড়ু, রাজস্থান, নাগাল্যাণ্ড, মিজোরাম নামগুলি চলছে হুবহু সেই অর্থেই গৌড়দেশকে ‘বাঙালীস্তান’ বললেও মহাভারত অশুদ্ধ হবে না৷ বরং ওই নাম এই পরিচিতিই বহন করে যে দেশটা বাঙালীদের মাতৃভূমি৷

সমগ্র বাঙালীস্তানকে আর্থিক দিক থেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে’ তুলতে হ’লে দু’টি বিষয়েরর ওপর গুরুত্ব দিতে হবে–জীবনযাপনের জন্যে নূ্যনতম প্রয়োজনগুলির উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা, ও ব্যাপকভাবে অর্থকরী ফসল ও অ–কৃষি শিল্পের উৎপাদন৷

নূ্যনতম প্রয়োজন পূর্ত্তির উৎপাদনের মধ্যে পড়বে পর্যাপ্ত খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা৷

খাদ্য উৎপাদন

খাদ্য উৎপাদনে বাঙালীস্তানের স্বয়ং সম্পূর্ণতার সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে শীতকালের বৃষ্টিপাতের স্বল্পতা, ও বর্ষাকালে জলনিকাশের সমস্যা৷ বর্ষাকালে বাঙলায় যথেষ্ট বৃষ্টি হয় ঠিকই, কিন্তু সেটা শুধু বছরের ৬ থেকে ৮ সপ্তাহ স্থায়ী হয়৷ ব্যাপক হারে বন ধ্বংস করায় প্রয়োজনের তুলনায় বাঙলায় বৃষ্টিপাত কমে’ গেছে৷ আর তার ফলে ফসলের উৎপাদনও কমে গেছে৷ নদীতেও জল খুব কমে’ যাওয়ায় সেচ ব্যবস্থাও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে৷ শীতকালে বৃষ্টি না হওয়ায় শীতকালীন ও গ্রীষ্মকালীন ফসল মার খাচ্ছে৷ জল নিকাশী ব্যবস্থার ত্রুটির জন্যে নদীর জলকে ফসল উৎপাদনের কাজে ঠিকমত লাগানো হচ্ছে না৷ এই ধরণের সমস্যার মোকাবিলা করতে সেচ ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে৷ বাঙলার যে সব অঞ্চলে বৃষ্টি কম হয়, বিশেষ করে’ রাৰা অঞ্চলে সেচ ব্যবস্থার ওপর গুরুত্ব দিয়ে নালা সেচ, তোলা সেচ, সায়র ও নদীতে ছোট ছোট বাঁধের ব্যবস্থা করতে হবে৷ ময়ূরাক্ষী, কোপাই, অজয়, বক্রেশ্বর, দ্বারকা, বরাকর, কাঁসাই, কুমারী, দুলুং, কেলেঘাই, ছোটকী গুয়াই, বড়কী গুয়াই, সুবর্ণরেখা প্রভৃতি রােের নদীগুলিতে ক্ষুদ্র সেচ প্রকল্পের কাজ করতে হবে৷৪৭

দামোদরের গর্ভদেশ বর্ধমান জেলার অববাহিকার চেয়ে কোথাও কোথাও উঁচু হয়ে গেছে৷ কোথাও বা তা হতে চলেছে৷ এ অবস্থায় দামোদর থেকে কোথাও যদি বিপুল পরিমাণে জলের ঢল নেমে আসে তাহলে বর্দ্ধমান, হুগলী ও হাওড়া জেলা যে প্লাবিত হবে তাতে সন্দেহই নেই৷ এ অবস্থায় কার্যকরী পন্থা হচ্ছে ড্রেজারে করে’ দামোদরের গর্ভদেশ থেকে বালি–পলি সরিয়ে দিয়ে পাশের জমির চেয়ে নদীর খাতকে অনেকখানি গভীর করে’ দেওয়া৷ আর খরচ এড়াবার জন্যে তা যদি না করা হয় তাহলে দামোদরের পাশে সুউচ্চ বাঁধ দিতেই হবে৷ অজয় নদীর গর্ভদেশে পলি জমে ক্রমশঃ তা উঁচু হয়ে উঠেছে৷ দক্ষিণ বীরভূমে অজয় অববাহিকার কিছু অংশের মাটিতে বালির ভাগ অত্যন্ত বেড়ে গেছে৷ তবে এখনো সে জমিতে বেলেমাটির ফসল, শীতের কন্দ ও আখের চাষের সুযোগ রয়েছে৷ আর দেরী করলে সেই সুযোগ নাও থাকতে পারে৷ তখন যন্ত্রের সাহায্যে ওপরের বালি সরিয়ে তবে চাষের জমি কেটে বার করতে হবে৷ অজয়ের দক্ষিণাংশে বর্দ্ধমান জেলার ঠিক সেই অবস্থা এখনই না এলেও এর গর্ভদেশ এরই উপনদী কুনুরের চেয়ে উঁচু৷ যার ফলে কুনুরের জল অজয়ে না ঢুকে অজয়ের জল সময়ে সময়ে কুনুরে ঢুকে যায়৷ এই অবস্থাটা বাঞ্ছনীয় নয়৷ কেবল ডাইক* দিয়ে এ সমস্যার সমাধান হবে না৷২৪

কলকাতা বন্দরকে বাঁচাতে ভাগীরথী নদীর নাব্যতা যে কোন মূল্যে রাখতেই হবে৷ ভারত সরকার এই জন্যে ফারাক্কা ব্যারাজ করেছিল৷ কিন্তু বাঙলাদেশের নদীগুলো যাতে শুকিয়ে না যায়, আর অর্থনীতি যাতে ধ্বংস না হয়ে যায় সেই জন্যেই ফারাক্কা ব্যারেজ থেকে ভারত যতটা জল নেবে, বাঙলাদেশকেও ততটা জল দেওয়া উচিত৷ ভারতের অংশের জলের ঘাটতিটা পূরণ করতে হবে ব্রহ্মপু– থেকে জল এনে৷ এতে বাঙলাদেশের কোন ক্ষতি হবে না৷ ধুবড়ি থেকে রামপুর, দীনাজপুর হয়ে, মালদার মানিকচক হয়ে ব্রহ্মপু–ের জল যাতে গঙ্গায় পড়ে তার সুব্যবস্থা করলে মালদা–নদীয়ার চাষীকে অগভীর বা গভীর নলকূপের ব্যবহার করতে হবে না৷

(ক্রমশঃ)