প্রাউট প্রবক্তার ভাষায়

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

নেশন  (Nation)

ভারতবর্ষ থেকে ব্রিটিশের চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে অর্র্থৎ ব্রিটিশ-বিরোধী সেন্টিমেন্টের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে উচিত ছিল  এদেশে একটা নূতন সেন্টিমেন্ট গড়ে তোলা--- ভারতীয় নেতারা তা করেন নি৷ পাকিস্তানী নেতারা কিছুটা করেছেন৷ তাঁরা ব্রিটিশ-বিরোধী সেন্টিমেন্টের স্থলে গোড়ার দিকে কাজে লাগিয়ে ছিলেন হিন্দু-বিরোধী সেন্টিমেন্টকে,তারপর কশ্মীর সমস্যাকে কেন্দ্র করে গড়ে তুললো ভারত বিরোধী সেন্টিমেন্টকে৷ এই সেন্টিমেন্টগুলো নেশন হিসেবে পাকিস্তানের জনগণকে কিছুটা সাহায্য করেছে৷ কিন্তু ভারতবর্ষে কোন সেন্টিমেন্ট গড়ে ওঠেনি৷ পাকিস্তানের মত সুযোগ ভারতেও এসেছিল৷ তারাও পাকিস্তান বিরোধী সেন্টিমেন্ট, গোয়াকে কেন্দ্র করে পর্তুগীজ-বিরোধী সেন্টিমেন্ট, ভারতবর্ষের  ওপর চীনের আক্রমণকে কেন্দ্র করে চীন-বিরোধী সেন্টিমেন্টের দ্বারা ব্রিটিশ-বিরোধী সেন্টিমেন্টের শূন্যস্থান পূরণ করে ভারতীয় নেশনকে জীইয়ে রাখতে পারত৷ কিন্তু তারা তা করেনি, নেতারা কল্পনার আকাশে উড়ে বেড়িয়েছেন৷

সবচেয়ে পরিতাপের কথা  হচ্ছে এই যে কোন মজবুদ সেন্টিমেন্টের ভিত্তিতে নেশন গড়ার চেষ্টা তো হয়-ই নি, বরং ভারতীয় সমাজের অভ্যন্তরে যেটুকু বা পারস্পরিক ভালবাসা, প্রেম, সৌহার্দ্র্য ছিল তাও নেতাদের হঠকারিতায় নষ্ট হতে বসেছে৷ বর্তমানে ভারতীয় নেত্তৃত্বের যে তিনটি প্রধান ক্রটির দরুণ ভারতবর্ষের  সংহতি নষ্ট হতে বসেছে তাদের একটি হচ্ছে ভাষা ভিত্তিক  প্রদেশ গঠনের প্রচেষ্টা, দ্বিতীয়টি হ’ল রাষ্ট্র ভাষা, আর তৃতীয়টি হ’ল উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে কেবলমাত্র স্থানীয় ভাষার ব্যবহার৷

আগেই বলেছি, বহু ভাষা, বহু ধর্মমত, বহু আচার-ব্যবহারের সমন্বয়ে যে ভারতবর্ষ গড়ে উঠেছে, যার জনগণের পারস্পরিক ভেদ-বিভেদ ইংরেজ, জার্র্মন,ফরাসী প্রভৃতি নেশনগুলোর পার্থক্যের চাইতে কোন অংশে কম নয়, সেখানে এই পার্থক্যগুলোকে কেন্দ্র করে কোন সেন্টিমেন্ট গড়বার সুযোগ দিলে তার ফল যে অত্যন্ত মারাত্মক হবে  একথা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একজন সাধারণ ছাত্রও সহজেই বুজতে পারে৷ অথচ ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠনের কাজে হাত লাগিয়ে নেতারা ঠিক সেই ভুলটাই করেছেন৷ আজ বিভাগ, জেলা, মহকুমা, থানা, এমনকি গ্রামের সীমানা নির্র্ধরণ নিয়ে বিভিন্ন ভাষাভাষী গোষ্ঠীর মধ্যে মন কষাকষি চলছে৷ যে দেশে এখন নেশন বলেতে কিছুই নেই সেই দেশে এই পারস্পরিক বিবাদের পরিণাম কত মারাত্মক, ভারতের শুভানুধ্যায়ী মাত্রেরই তা ভেবে দেখবার দিন এসেছে৷ অল্প কিছুটা সময়ের মধ্যেই যদি সম্পূর্ণ ভাষার ভিত্তিতে প্রদেশগুলি গড়ে দেওয়া হ’ত তাহলেও না হয় কথা ছিল কিন্তু তা তো হয়নি৷ স্বাভাবিকভাবেই ভাষার ভিত্তিতে রাজ্যগুলির প্রকৃত সীমানা ঠিক মতো নির্র্ধরণ করাও সম্ভব নয়, প্রত্যেক রাজ্যে কিছু না কিছু  দ্বিভাষী বা ত্রিভাষী অঞ্চল থেকেই যাবে৷ তবুও ভাষার ভিত্তিতে যতটুকু করা সম্ভব ছিল, তাও করা হয়নি৷ আর এর ফলে হয়েছে কি?--- না, ভারতবর্ষের সর্বত্রই ভাষাগত সংখ্যালঘুরা এক নৈরাশ্যের দ্বারা গ্রস্ত রয়েছে৷

ভারতের আভ্যন্তরীণ ঐক্য অত্যন্ত দ্রুত অবনতির পথে চলেছে৷ ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠনের কাজে হাত লাগিয়ে  তার শেষ রক্ষা করতে না পারায় ভারতের সংহতির পক্ষে তা’ অত্যন্ত মারাত্মক হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ অবশ্য ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গড়ার কথাটা তোলাই উচিত হয়নি৷ কিছুদিন আগে কোন একটি প্রদেশের নেতৃস্থানীয় কিছু লোকেরাই বলতে শুরু করেছিলেন যে সীমানা কমিশন তাঁদের প্রতি সুবিচার করেনি--- তাই তাঁরা ভারতবর্ষ থেকে আলাদা হয়ে যাবেন৷ বুঝুন তথাকথিত ভারতীয় নেশনের কী শোচনীয় অবস্থা৷