বৈশ্যযুগের অবসান চাই

লেখক
মনোজ দেব

সম্প্রতি এক পরিসংখ্যানে প্রকাশ বেকারত্বের জ্বালায় দেশে  আত্মহত্যা বেড়েছে ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় কেন্দ্রীত অর্থনৈতিক কাঠাময় শুধু বেকারত্ব নয়, অর্থনৈতিক বৈষম্য, অভাব অনটন মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে৷ ভারতের মতো জনবহুল দেশে  কোন পরিসংখ্যানই সঠিক তথ্য দিতে পারে না৷ তাই পরিসংখ্যানের থেকেও ভয়াবহ অবস্থা কর্মহীন ও বেকারদের৷ ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় বেকারের সংখ্যা স্বাভাবিক ভাবেই বৃদ্ধি পেতে থাকে৷ শিল্পপতিরা তাদের শিল্পের জন্যে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে৷ তাদের মুনাফার অংক বৃদ্ধির জন্যে এটা তারা করবেই৷ যে কাজ ১০০ জনের দ্বারা হচ্ছিল, অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে সে কাজ হয় তো ২০ জনকে দিয়ে করার চেষ্টা করবে৷ আর তখন শিল্পপতিরা ক্রমর্ধমান হারে কর্মী ছাঁটাই করে চলবে৷ যদিও প্রাউটের ‘সামূহিক অর্থনীতি’তে বলা হয়, এ সব ক্ষেত্রে প্রয়োজনে কাজের সময় হ্রাস করা উচিত, কিন্তু কোনো ক্রমে শ্রমিক ছাঁটাইকে মানা যায় না, কিন্তু ধনতান্ত্রিক অর্থনীতিতে ধনিক শ্রেণী তার লাভটাকেই বাড়াতে চাইবে, তাই তারা যতদূর সম্ভব কম শ্রমিক নিয়োগ করবে৷ ধনতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় এই প্রবণতা বাড়বেই আর তার ফলে যে কোনো দেশের বেকার সংখ্যা বৃদ্ধি পাবেই৷

আমেরিকা, জার্মানী, জাপানের মত অর্থোন্নত দেশে বিপুল সংখ্যার শ্রমিক ছাঁটাই–এর সংবাদ গত কয়েক বছর ধরেই প্রকাশিত হচ্ছে৷ এ কারণে ওই সমস্ত দেশে পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে মাঝে মধ্যেই বিক্ষোভ–আন্দোলন দেখা দেয়৷ ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেয়৷ ব্যাঙ্ক ফেল করতে থাকে৷ তখন পুঁজিবাদী সরকার ব্যাঙ্ক ব্যবসায়ীদের বিপুল অর্থ সাহায্য করে সেখানকার অর্থনীতিকে ঠেকনা দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখে৷

তাই এই সমস্যা কেবল ভারতের নয়, বা একটা দুটো দেশের নয়, এটা বিশ্বব্যাপী সমস্যা৷ এ সমস্যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দুর্নীতি, নারী নিগ্রহ প্রভৃতি নানান্ সামাজিক অপরাধ

কিন্তু আমাদের ভুললে চলবে না, এ সমস্ত সমস্যা এক সূত্রে গাঁথা৷ সে সূত্রটা কী? না, প্রাউট–প্রবক্তা বলেছেন, সারা পৃথিবী জুড়েই বর্তমানে মোটামুটি বৈশ্যযুগ চলছে৷ ‘বৈশ্য যুগ’ মানে পুঁজিপতি (বৈশ্য) শ্রেণীর প্রাধান্যের যুগ৷ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে এই বৈশ্য শ্রেণী কেবল অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, সমাজের সব ক্ষেত্রেই তারা প্রভাব বিস্তার করে৷ যেমন, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে– গণতন্ত্রে নির্বাচনের সময় বিপুল পরিমাণ অর্থ সাহায্য করে তারা অযোগ্য প্রার্থী তথা রাজনৈতিক দলকে জিতিয়ে দেয়৷ এই ভাবে শাসক দলকে বশীভূত করে সরকারকে দিয়ে নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধি করে৷ সরকার তখন জনগণের স্বার্থ রক্ষার চেয়ে পুঁজিপতিদের স্বার্থ রক্ষায় বেশি তৎপর হতে বাধ্য হয়৷

এই ভাবেই আমরা দেখেছি, কট্টর পুঁজিপতি–বিরোধী মার্কসবাদী কম্যুনিষ্ট পার্টি শেষ পর্যন্ত টাটা বা সালেম গোষ্ঠীর মত যথাক্রমে দেশী ও বিদেশী পুঁজিপতিদের হাতের পুতুলে পরিণত হয়ে দরিদ্র–জনসাধারণে স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়৷ যার পরিণতিতে ক্ষুদ্ধ জনসাধারণ এই তথাকথিত ‘সর্বহারা–পার্টি’–কে ক্ষমতার উচ্চাসন থেকে টেনে হিঁচড়ে নীচে নামিয়ে আনে৷

এই ভাবে এই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকার পরিবর্তন হলেও নবাগত সরকারের হাতে বিকল্প কোনো সামাজিক–র্থনৈতিক দর্শন না থাকায় সাময়িক ভাবে তাঁরা কিছু কিছু ক্ষেত্রে জনগণের কিছু কল্যাণ করলেও সর্বগ্রাসী বৈশ্য শোষণের অবসান ঘটাতে পারে না৷ বরং বৈশ্য শ্রেণীর পাতা জালে তারাও বাঁধা পড়ে যায়৷

শোষক বৈশ্য শ্রেণী অক্টোপাশের মত সমস্ত সমাজকে জড়িয়ে ধরে অর্থশক্তির হাতিয়ারের সাহায্যে সমাজের অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক প্রভৃতি প্রায় সমস্ত প্রতিষ্ঠানগুলিকে শোষণ করতে থাকে৷

বৈশ্যের মূল্যবোধ হ’ল ‘সর্বে গুণাঃ কাঞ্চনম্ আশ্রয়ন্তি’– ‘দুনিয়া টাকার বশ’৷ আর এই ভাবে বৈশ্যেরা উদ্দাম ভোগবাদের বিষবাষ্পে গোটা সমাজকে কলুষিত করে দেয়৷ বৈশ্যের সর্বগ্রাসী মানস–র্থনৈতিক শোষণ সমগ্র সমাজকে সার্বিক অবক্ষয় তথা সার্বিক বিপর্যয়ের গভীর গহ্বরে নিক্ষেপ করে৷ আজ সমাজের কোণায় কোণায় যে অনাচার, ব্যভিচার, যে বর্বরতার প্রকাশ তার মূলে আছে বৈশ্য শোষণ৷ তাই আজ সবচেয়ে বড় কথা হ’ল এই বৈশ্যযুগের অবসান ঘটিয়ে সর্বাত্মক শোষণমুক্ত মানব সমাজ গড়ে তোলার জন্যে সর্বাত্মক কর্মযজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়া আধ্যাত্মিক ও নব্যমানবতাবাদে আধারিত প্রগতিশীল উপযোগতত্ত্বের প্রতিষ্ঠায়৷