বাংলা বানান সংস্কার

লেখক
জ্ঞানভিক্ষু

প্রাউট–প্রবক্তা মহান দার্শনিক ঋষি শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার ভাষাতত্ত্ব ও ব্যাকরণ বিজ্ঞানের ওপরও বহু অমূল্য পুস্তক রচনা করেছেন, যা কলকাতা, ঢাকা, কল্যাণী প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা অধ্যাপক সহ বিশিষ্ট ভাষাতাত্ত্বিক ও জ্ঞানী গুণীজনের দ্বারা বহুল প্রশংসিত৷ তাঁর রচিত ‘প্রভাতরঞ্জনের ব্যাকরণ বিজ্ঞানে’ তিনি বহু প্রচলিত বাংলা বানানের ভুলত্রুটি বা অর্থবিচ্যুতি দেখিয়ে সে সবের সংস্কার সাধনেও সচেষ্ট হয়েছেন৷ এ ধরনের কিছু বাংলা বানান সম্পর্কে তাঁর অভিমত তাঁর ভাষাতেই প্রকাশ করা হচ্ছে ঃ

ব্যক্তি/ব্যষ্টি

মানুষ অর্থে ‘ব্যক্তি’ শব্দটি একটি আপাদমস্তক ভুল শব্দ৷ মানুষ অর্থে ‘ব্যক্তি’ শব্দটির ব্যবহার কোন শুভ লগ্ণে হয়েছিল তা ভাষাবিজ্ঞানের পণ্ডিতেরা বলতে পারেন–তা আমার মত প্রাকৃত জনের কর্ম নয়৷ ‘ব্যক্তি’ শব্দটির মানে হচ্ছে ফুটিয়ে তোলা৷ মেয়েরা কাপড়ের ওপর যে সূচীকর্ম করেন তাকে যদি কেউ ‘সূচীব্যক্তি’ বলেন আমার তাতে আপত্তি নেই কিন্তু মানুষকে ব্যক্তি বলতে আপত্তি রয়েছে৷

‘ব্যক্তি’ কথাটা মানুষ বা person অর্থে ব্যবহার না করে ‘‘ফুটে ওঠা’’ বা expression অর্থেই ব্যবহূত হলে individual বা personal অর্থে বাংলায় কোন শব্দটা ব্যবহার করা উচিত? Person অর্থে ‘ব্যক্তি’ যখন ব্যবহার করছি না তখন personal অর্থে ‘ব্যক্তিগত’ বা ‘বৈয়ক্তিক’ ব্যবহার করা উচিত নয়৷ হ্যাঁ, ঠিকই৷ Personal অর্থে ‘ব্যক্তিগত’ বা ‘বৈয়ক্তিক’ ব্যবহার না করাই বাঞ্ছনীয়৷ Person বা unit অর্থে বলা উচিত ‘ব্যষ্টি’ ও collective অর্থে ‘সমষ্টি’৷ অর্থাৎ personal অর্থে ভুল শব্দ ‘ব্যক্তিগত’ বা ‘বৈয়ক্তিক’ এর পরিবর্ত্তে ব্যবহূত হওয়া উচিত ‘ব্যষ্টিগত’ বা ‘বৈয়ষ্টিক’ আর collective অর্থে লেখা উচিত ‘সামষ্টিক’৷ বি–স  ক্তিন করে ‘ব্যষ্টি’ শব্দ নিষ্পন্ন হচ্ছে৷ ধাতুর উত্তরে ‘ক্তিন’ প্রত্যয়ে অবস্থাবিশেষে ‘তি’, ‘টি’ প্রভৃতি বানান ব্যঞ্জনের ব্যবহার আছে৷ এক্ষেত্রে ‘তি’ এর পরিবর্ত্তে ‘টি’ ব্যবহূত হবে কারণ ধাতুরূপে অস  তি করে ‘অস্তি’ ক্রিয়ারূপ আসছে৷ তাই ‘ক্তিন’ প্রত্যয়েও আবার যদি ‘তি’ সংযুক্ত হয়ে ‘অস্তি’ হয় তাহলে দুই ‘অস্তি’–র মধ্যে গোলমাল হয়ে যাবার সম্ভাবনা৷ ধাতুরূপে ‘অস্তি’–র উত্তরে আমরা ‘ইক্’ প্রত্যয় করে ‘আস্তিক’ শব্দও পেয়ে থাকি ও ভাল ভাবেই ব্যবহার করা হয়ে থাকে৷ এই জন্যে ‘ক্তিন’ প্রত্যয়ে ‘তি’–এর পরিবর্তে ‘টি’ ব্যবহার করা হয়ে থাকে৷ তাই ‘অস্থি’ হয়ে যাচ্ছে ‘অষ্টি’ কিন্তু ‘ট’ হচ্ছে মূর্ধ্য বর্ণ, আর ‘স’ হচ্ছে দন্ত্য বর্ণ যার সঙ্গে ‘টি’–এর সংযুক্তি হয় না৷ তাই ‘ট’–কে রাখতে গিয়ে দন্ত্য বর্ণ ‘স’–এর পরিবর্তে সংশ্লিষ্ট মূর্ধ্য বর্ণ ‘ষ’–কে ব্যবহার করতে হচ্ছে৷ আর শেষ পর্যন্ত তাই ‘অস্তি’ হয়ে দাঁড়াচ্ছে ‘অষ্টি’৷ তাই বি–অস্  ক্তিন্ করে হয়ে দাঁড়াল ‘ব্যষ্টি’৷ অনুরূপ ভাবেই সম–অস্  ক্তিন্ করে হয়ে দাঁড়াল ‘সমষ্টি’৷ ‘ব্যষ্টি’ থেকে আমরা পাচ্ছি ‘বৈয়ষ্টিক’ যার মানে personal ‘সমষ্টি’ থেকে ‘সামষ্টিক’ যার মানে collective৷ তোমরা personal অর্থে অবশ্যই ‘বৈয়ষ্টিক’ শব্দটি ব্যবহার করতে পার৷ তবে personal অর্থে  ‘বৈয়ক্তিক’ শব্দটি একেবারে ডাহা ভুল যেমন ভুল person অর্থে ‘ব্যক্তি’ শব্দটি৷ ‘‘একজন ব্যক্তি আসছে’’ বললে ডাহা ভুল হবে, বলতে হবে ‘‘একজন মানুষ আসছে’’ বা ‘‘এক জীবজন্তু আসছে’’ বা ‘‘একজন ব্যষ্টি আসছে’’৷

কর্ষক

এমনিতে যাঁরা চাষবাস নিয়ে থাকেন তাঁদের জন্যে সংসৃক্ত ভাষায় বেশি প্রচলিত শব্দ দু’টি রয়েছে–কৃষীবল ও কর্ষক৷ ‘কর্ষক’ শব্দটি কৃষ ধাতু থেকে উৎপন্ন৷ যাঁরা এই কর্ষককে ‘কৃষক’ বানিয়ে ফেলেছেন তাঁরা না জেনেই এই ভুল করেছেন৷ আর যাঁরা আজও ‘কৃষক’ লেখেন তাঁরা ভুলকে ভুল না জেনেই লেখেন৷ আমরা ‘আকর্ষক’ ‘বিকর্ষক’ বলবার সময় ঠিক বলি কিন্তু কেন বুঝি না ‘কর্ষক’ বলবার সময় ভুল করে কৃষক বলে ফেলি৷

সর্জন

তোমরা ভালভাবেই জান ’সৃজন’ শব্দটি ভুল৷ ‘সৃজ’ ধাতু  ল্যুট করে পাই ‘সর্জন’–‘সৃজন’ নয়৷ কারও মধ্যে সৃজনী প্রতিভা থাকে না–থাকে সর্জনী–প্রতিভা৷ আমরা ‘উৎসর্জন’, ‘বিসর্জন’–এর ‘সর্জন’ শব্দটি ঠিকই ব্যবহার করি৷ কেবল শব্দটি উপসর্গ রহিত অবস্থায় থাকলে গোলমাল করে থাকি–বলে ফেলি ‘সৃজন’, ‘সৃজনী’৷ এবার থেকে ‘সৃজন’ শব্দটি ব্যবহার কোরো না৷

উপর্যুক্ত

‘উপরি  উক্ত’–কে অনেকেই ভুল করে উপরোক্ত লেখেন, ভাবেন শব্দটা বোধহয় উপর  উক্ত = উপরোক্ত৷ সংসৃক্তে ‘উপর’ বলে কোন শব্দ নেই–আছে ‘উপরি’৷ এই ‘উপরি’  ‘উক্ত’  =  উপর্যুক্ত৷