বিদ্বেষ বিষে জর্জরিত রাজনীতি

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

একজন প্রাক্তন আর এস এস নেতা বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ করে আসছেন আর এস এস ও বিজেপি দলটা চরম বাঙালী বিদ্বেষী৷ দিল্লির ক্ষমতায় মোদি বসার পর থেকে বিজেপির বাঙালী বিদ্বেষী চরিত্রে আর কোন রাখ-ঢাক নেই, দিন দিন নগ্ণ হয়ে পড়ছে৷ এমন কি যদি কোন দিন বিজেপির স্বপ্ণের হিন্দু রাষ্ট্র গঠিত হয়, সে রাষ্ট্রে হিন্দু বাঙালীরও স্থান হবে না৷

বাঙলার প্রতি দিল্লীর বঞ্চনার শুরু সেই ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগষ্ট মধ্যরাত থেকে৷ বাঙলার কংগ্রেস নেতৃত্ব সেই দিন থেকেই দিল্লীর দাসত্ব স্বীকার করে নেয়৷ তাই স্বাধীনতার পর থেকে দীর্ঘবছর কেন্দ্রে ও গোটা দেশের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গও কংগ্রেস শাসনে ছিল৷ কিন্তু পঞ্জাব যেভাবে তার উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধান করেছে কেন্দ্রের সাহায্য ও সহযোগিতা নিয়ে, পশ্চিমবঙ্গ সেই সাহায্য ও সহযোগিতা পায়নি, পঞ্জাবের তুলনায় ছিটে ফোঁটাও পায়নি৷ বিধান রায়ের মতো ব্যষ্টিও পারেননি বাঙলার ন্যায্য পাওনা আদায় করতে৷ হয়তো তাঁর কাছে বাঙলার স্বার্থ অপেক্ষা নেহেরুর সঙ্গে সখ্যতা অনেক বড় ছিল৷ তাই নেহেরু সরকারের বাঙালী বিদ্বেষী আচরণের তিনি কোন দিন প্রতিবাদ করেননি৷ প্রখ্যাত সাংবাদিক রঞ্জিত রায় তাঁর ---‘ধবংসের পথে পশ্চিমবঙ্গ’ গ্রন্থে স্পষ্টতই লিখেছেন---বিধান রায়ের সময় থেকেই পশ্চিমবঙ্গের অবনতির শুরু৷ তবে বাঙলা দখলের চিন্তা যেহেতু ছিল না, দিল্লীর বঞ্চনা নেহেরু আমলে বিদ্বেষে পরিণত হয়নি৷ মূল লক্ষ্য ছিল বাঙলার প্রাকৃতিক সম্পদের (বনজ, জলজ, কৃষিজ খনিজ) উপর৷ জোরপূর্বক হিন্দি চাপিয়ে বাংলা ভাষা, সাহিত্য সংস্কৃতিকে অবদমিত করার চক্রান্তও নেহেরু আমল থেকেই শুরু৷ দক্ষিণ ভারত হিন্দি আগ্রাসন রুখতে পারলেও পশ্চিমবঙ্গ পারেনি কারণ বঙ্গীয় কংগ্রেস নেতারাই দিল্লির দাসত্ব মেনে নিয়েছিল৷ বিধান রায়ও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না৷

২০১৪ সালে প্রথম নির্বাচনী প্রচারে এসে মোদি তার মনের কথাটি বলে ফেলেছিলেন---বাঙালীরা বাক্স পেঁটরা নিয়ে তৈরী থাকুক, ভোটের পর বাঙলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হবে৷ মোদির এই কথার প্রতিবাদ পশ্চিমবঙ্গের গুজরাটিরাও করাতে মোদি আর দ্বিতীয়বার ওই কথা উচ্চারণ করেননি৷ কিন্তু ক্ষমতায় বসার পর এন.আর.সি, সিএএ এর মূল লক্ষ্যই বাঙালী জনগোষ্ঠী৷ মোদি অমিত শাহ বুঝেছে এন.আর.সি, সিএএ এর সার্থক রূপায়ণ করতে হলে পশ্চিমবঙ্গ দখল জরুরী বিশেষ করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সরাতেই হবে৷ ২০২১-এ রাষ্ট্র ক্ষমতা, আর্থিক ক্ষমতা, সাংঘটনিক ক্ষমতা প্রয়োগ করেও সফল হয়নি মোদি অমিত সাহ, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নির্বাচনে হার জিত থাকবেই৷ কিন্তু বিজেপি দলটার গণতন্ত্রের শিক্ষাই নেই৷ গুজরাটিদের মধ্যেও স্বৈরাচারী প্রবণতা গান্ধী সুভাষ বিরোধের সময় থেকেই দেখা গেছে৷ বিশ্বকবি লিখতে বাধ্য হয়েছিলেন---‘‘স্বাধীনতার মন্ত্র উচ্চারণ করবার জন্যে যে বেদী উৎসৃষ্ট, সেই বেদীতেই আজ ফ্যাসিস্টের সাপ ফোঁস করে উঠেছে৷

রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে বার বার পরাজিত হয়ে গণতন্ত্রের মুখোস খুলে বিজেপি তার ফ্যাসিস্ট চেহায় ক্রমশ প্রকাশ করছে৷ মুর্শিদাবাদের ঘটনাও কোন সাম্প্রদায়িকতা নয়, ওই ফ্যাসিষ্ট সাপের ছোবল৷ নির্বাচনে পরাজয়ের জ্বালা ভুলতে বাঙলার ন্যায্য প্রাপ্য দীর্ঘদিন ধরে আটকে রেখেছে৷ তাতেও রাজ্য সরকারের জনকল্যাণমুখী প্রকল্পগুলি বন্ধ করতে না পেরে হতাশার জ্বালায় হিংস্র হয়ে উঠছে বিজেপি নামক দলের কেন্দ্র থেকে রাজ্যস্তরের নেতারা৷

বিজেপির লড়াইটা রাজনৈতিক স্তরে ছিল তৃণমূলের বিরুদ্ধে৷ সেই লড়াই-এ হারের গ্লাণি জাতি বিদ্বেষে পরিণত হয়েছে৷ হতে পারে এটা কোনো একটি জনগোষ্ঠীর জাতীয় চরিত্র, গান্ধী সুভাষ বিরোধের সময়ও এই বিদ্বেষ পরিলক্ষিত হয়েছে৷ এই বিদ্বেষের স্বীকার বাঙালী জনগোষ্ঠী৷ এই বিদ্বেষের বীজ ছড়িয়েছে জাতীয় কংগ্রেসের গান্ধী লবির হাত ধরে৷ প্রধানমন্ত্রী মোদি কংগ্রেসমুক্ত ভারত চাইলেও কংগ্রেসের বাঙালী বিদ্বেষের চরিত্রকেই আঁকড়ে ধরেছে৷ সেই বিদ্বেষ বিষে জর্জরিত বাঙলার রাজনীতি৷ মুর্শিদাবাদের ঘটনা এই বিষাক্ত রাজনীতিরই পরিণতি৷ আগামী এক বছর বিজেপির বিষাক্ত রাজনীতির পরিনামে বাঙালীর সামনে আরও ভয়ঙ্কর দিন আসতে পারে--- কবি গুরুর সতর্ক বাণী --- ‘হিংস্র দুঃসমের পিঠের ওপর চড়ে বাঙালীকে বিভিষিকার পথ অতিক্রম করতে হবে’৷ বিজেপির বিদ্বেষ বিষে জর্জরিত রাজনীতি সেই বিভীষিকার পথ৷ বাঙালীকে এই পথ অতিক্রম করতেই হবে৷