ভাষার ক্ষেত্রে অবদমন চলবে না

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

ভাষা মানুষের অন্তরের ভাব প্রকাশের এক শক্তিশালী মাধ্যম৷ এই ভাষা মানুষের প্রাণীন সম্পদ–যা তার প্রাণধর্ম অর্থাৎ সত্তাগত বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সম্পর্কিত৷ নিজস্ব মাতৃভাষায় একজন যেমন স্বচ্ছন্দে ও সাবলীল ভাবে নিজের ভাবকে প্রকাশ করতে পারে তেমনটি অন্য কোন ভাষায় পারে না৷ মাতৃভাষা ছাড়া অন্য ভাষায় কথা বলতে সে অসুবিধা বোধ করে৷ প্রতিনিয়তই যদি অন্য ভাষায় কথা বলিয়ে এরূপ অস্বচ্ছন্দ বোধ করতে তাকে বাধ্য করান হয়, তবে তার প্রাণশক্তি অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হবে–ক্রমশ প্রাণশক্তি দুর্বল হয়ে পড়বে৷ এই রকম পরিস্থিতিতে সেই ব্যষ্টি বা ব্যষ্টি সমূহের মধ্যে এক মনস্তাত্ত্বিক সংকট দেখা দেবে৷ প্রথমেই তার মধ্যে দেখা দেবে এক ধরণের হীনম্মন্যতা বোধ, যা মানুষের মানসিক দুর্বলতার কারণ৷ যাদের ভাষা অবদমিত হবে তাদের নৈতিক সাহস, উদ্যম ও প্রতিবাদ করার শক্তি হারিয়ে যাবে৷ শেষ পর্যন্ত তাদের মধ্যে একটা পরাজিতের মনোভাব জাগবে–যা কোন জনগোষ্ঠীর প্রাণ স্পন্দনকে অচিরেই স্তব্ধ করে’ দেবে৷ সুতরাং ভাষার অবদমন মানুষের মনে মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে৷ এই ধরণের ক্রমাগত অবদমনের ফলে জনগণ কখনই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না, ও তাদের অকালে অস্বাভাবিক মৃত্যু ঘটবে৷ এ বিষয়ে সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হচ্ছে যে, ভাষার ক্ষেত্রে অবদমিত এই জনগোষ্ঠী মানস–র্থনৈতিক শোষণের চাপে পড়ে’ সব সময় আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে থাকবে৷ এটা অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে, ভারতবর্ষ সমেত সমস্ত পৃথিবীতে এই ট্র্যাজেডীটাই ঘটে চলেছে৷

সম্প্রতি কানাডা ও ওয়েলসের লোকেরা ইংরেজী ভাষার অধ্যারোপের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে৷ তারা চায় তাদের নিজেদের ভাষাকেই ভাবপ্রকাশের বাহন হিসেবে রাখতে৷ বর্ত্তমান ভারতেরও স্বার্থপর দলগুলোর রাজনৈতিক প্রচেষ্টায় ভোজপুরী, মৈথিলী, মগধী, ছত্রিশগড়ী, অবধী, বুন্দেলখণ্ডি, মাড়োয়ারী প্রভৃতি ভাষা অবদমিত হয়ে চলেছে৷ হিন্দীকে জোর করে’ চাপাবার প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ সৃষ্টি হয়েছিল৷

তাই প্রাউট সুষ্পষ্ট ভাবে বলে যে, প্রত্যেক প্রগতিশীল সমাজ ব্যবস্থায় সমস্ত ভাষাকেই সমান স্বীকৃতি, সুযোগ ও অধিকার দিতে হবে৷ একথা মনে রাখতে হবে যে, এই স্বীকৃতি কেবল তত্ত্বগতভাবে ও পঠন–পাঠনে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না৷ এ হতে হবে বৈবহারিক–অর্থাৎ প্রাত্যহিক জীবনের সকল কর্মে এর স্বীকৃতি দিতে হবে৷ জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে–অফিস, আদালত, রেলওয়ে, বিমানবন্দর, ব্যবসা–বাণিজ্য ও সরকারী–বেসরকারী সমস্ত কাজে প্রকাশের মাধ্যম হওয়া উচিত মাতৃভাষা৷

শিক্ষা–সংক্রান্ত ব্যাপারে নিজের মাতৃভাষা ছাড়া অন্যান্য ভাষাতে জ্ঞানচর্চা ও জ্ঞানের পরিধি বাড়ানোর ক্ষেত্রে কোন বিধি–নিষেধ থাকা উচিত নয়৷ মোটের ওপর বৈবহারিক ক্ষেত্রে যেখানে বিশেষ ধরণের বা প্রযুক্তিগত প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, সে সরকারী হোক বা বেসরকারী হোক, সে সব ক্ষেত্রে শুধু মাতৃভাষায় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করলে তা বিভ্রান্তির সৃষ্টি করতে পারে৷ সে রকম পরিস্থিতিতে এক সর্বজনগ্রাহ্য ভাষা ব্যবহার করা যেতে পারে৷ সমাজের অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্যের দিকে লক্ষ্য রেখে এটা মনে রাখা উচিত যে, সব ভাষাকে সমান সুযোগ প্রদান, ও প্রয়োজন অনুযায়ী যোগাযোগরক্ষাকারী ভাষা হিসেবে কোন জাতীয় ভাষা বা বিশ্ব–ভাষা প্রসারের মধ্যে কোন বিরোধ থাকা উচিত নয়৷ দেখতে হবে যোগাযোগ রক্ষাকারী ভাষা হিসাবে যাকে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে তা যেন অন্য ভাষাকে অবদমন না করে৷ ভাষা সমস্যার সমাধানের যথার্থ নীতি ও কর্মপদ্ধতি নির্ধারণ করতে হলে চাই দূরদৃষ্টি, সহনশীলতা, বাস্তবজ্ঞান, বিশ্বপ্রেম, যথার্থ আদর্শ, আন্তরিকতা ও বিচক্ষণতা–আর এগুলিকে পাথেয় করে’ নিয়ে চললে শুধু ভাষা সমস্যা কেন–আমাদের ঝঞ্ঝা–বিক্ষুদ্ধ জীবনের যে কোন কঠিনতম সমস্যার সমাধান সহজ হয়ে যাবে, ও আমাদের সমগ্র অস্তিত্ব বিজয়গৌরবের আলোকচ্ছটায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে৷

মানুষ মানুষের সঙ্গে যত বেশী মিলে–মিশে, হাতে হাত মিলিয়ে, কাঁধে–কাঁধ মিলিয়ে চলবে, মানবজাতির ততবেশী কল্যাণ৷ কেউ যেন জীবনের কোন ক্ষেত্রে–ন্যাশান্যালিটিতেই হোক, ভাষাতেই হোক, রেলিজনেই হোক বা অন্য কোন কিছুতেই হোক–অন্যকে যেন দাবিয়ে রাখবার চেষ্টা না করে৷ মানুষের মনীষার সম্পূর্ণ অভিব্যক্তির পথ যেন সব সময় খোলা থাকে৷   

উৎস

(প্রাউটের রূপরেখা)