‘রুষ্’ ধাতুর অর্থ হল অবদমিত ক্রোধ................ ক্রোধে ফেটে পড়া নয়৷ যেক্ষেত্রে ক্রোধে ফেটে পড়া হচ্ছে তাকে বলি ক্রোধ, আর যে ক্ষেত্রে তাকে চেপে রাখা হচ্ছে তাকে বলি রোষ৷ ক্রোধটাকে সঙ্গে সঙ্গেই বুঝে নেওয়া যায় কিন্তু রোষকে বুঝতে একটু সময় লাগে ৷ কেউ হয়তো তোমার ওপর একটু রুষ্ট হল৷ তারপর আবার সব ঠিকঠাক হয়ে গেল৷ তুমি সেই ঘটনাটার কথা হয়তো ভুলেই গেছ৷ তার বেশ কিছুটা পরে তুমি তাকে খাবার জন্যে ডাকলে৷ সে গম্ভীর মুখে বললে, ‘‘আমি /আজ/খাবনা৷’’ তখন তুমি ্বুঝলে তার মনের মধ্যে চাপা ক্রোধ ছিল৷ একেই বলে রোষ৷
তুমি যেখানে কাজ কর সেখানকার বড় কর্তা মনে মনে তোমার ওপর রুষ্ট৷ কিন্তু মুখে তা জানতে দেয় না৷ তোমাকে বেশ সাবধানে তাকে নিয়ে ঘর করতে হয় অথবা নিয়মিত ভাবেই বুদ্ধির লড়াই চালিয়ে যেতে হয়৷ মনে কর , স্কুলের হেড মাষ্টারমশাই তোমার ওপর খু রুষ্ট৷ রুষ্ট , তাই মুখে জানতে দিচ্ছেন না৷ তুমি তোমার বন্ধুর বিয়েতে বরযাত্রী যাবে৷ ছুটির দরখাস্ত করেছ৷ ইস্কুলের হেড মাষ্টার ছুটি দিলেন না৷ ললেন ---‘‘এখন কাজের দারুন চাপ, দু’জন শিক্ষক ইনফ্লুয়েঞ্জায় ভুগছেন৷ এ অবস্থায় ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আপনাকে ছুটি দিতে পারছিনা৷’’ তুমি আসল জিনিসটা বুঝে গেলে কিন্তু কিছু করার নেই৷ তুমি বুদ্ধির লড়াইয়ে নাবলে আবার ঠিক করে দরখাস্ত লিখলে---‘‘আমার মাতৃদেবী গুরুতর অসুস্থ৷ এই আছেন এই-নেই অবস্থা৷ সুতরাং আমাকে তিন দিনের জন্যে ছুটি দেওয়া হোক৷’’ তোমার বুদ্ধির চাপে হেডমাষ্টার মশাই ছুটি দিতে বাধ্য হলেন৷ তারপরই তুমি গিলে-করা পাঞ্জাবী পরে হাসতে হাসতে বরযাত্রীতে সামিল হলে৷ তাহলে বুঝলে এই রোষকে কীভাবে সামলাতে হয়৷ এই রোষের জন্যে ‘র’ শব্দ ব্যবহার্য৷ আবার যে রুষ্ট হয়েছে তার জন্যেও এই ‘র’ শব্দ ব্যবহার্য্য৷
ছুটির দরখাস্তের কথা লতে গিয়ে আমার ইংরেজ আমলের একটা গল্পের কথা মনে পড়ল৷
তোমরা শান্তিপুরের কালীকৃপা ভট্চাজকে চেনো কি? চিনবেই বা কী করে? সে তা অনেক দিনের কথা হল৷ সেটা ইংরেজ আমল৷ কালী ভট্চাজ কাশীতে চাকরি করতেন--- ভাল মাইনের চাকরি৷ সেকালে অল্প ইংরেজী জানলেই সরকারী চাকরি জুটে যেত৷ বলা হয়ে থাকে সেকালে একশ্রেণীর মানুষের জীবনে ছিল চারটে ফরম৷ প্রথম ফরমটি আসত ইংরেজী মাধ্যম স্কুলে ভর্তি হওয়ার ফরম৷ দ্বিতীয় ফরমটি আসত abcd শিখে নেবার পর সেই ইস্কুল থেকে সার্টিফিকেট নেবার দরখাস্তের ফরম৷ তৃতীয় ফরমটি হত রেলের চাকরিতে ঢোকার দরখাস্তের ফরম৷ চতুর্থ ফরম হত হাতে রেলের ফ্ল্যাগ নিয়ে রেলইষ্টিশনের প্ল্যাটফরম৷ কালী ভট্চাজ ছিলেন এদের চেয়ে অনেক উন্নত মানের ৷ তিনি যখন আগে রেল ইষ্টিশনের ষ্টেশন মাষ্টার ছিলেন তখন থেকে তাঁর মুখে ইংরেজীর খই ফুটত৷ একবার তাঁরই ইষ্টিশনে দাঁড়িয়ে থাকা একটি মালগাড়ীর সঙ্গে ছুটে আসা একটা মেলগাড়ীর ধাক্কা লাগে, তার ফলে একটা ড় রকমের দুর্ঘটনা ঘটে যায়৷ দিল্লী থেকে লালমুখো বড় বড় সাহেবরা তদন্ত করতে এলেন৷ কালী ভট্চাজ একটুও ঘাবড়াল না৷ তবে সাহেবরা যাতে একটু দয়াদাক্ষিণ্য করেন তাই সে গোড়ার দিকে নিজের দারিদ্র্যের কথা জানাতে গিয়ে ললে--- আই পুওর ম্যান স্যার,ইভ্ন দেন ফুরটী লীব্স্ ফুল ডেইলি ইন মাই হাউস স্যার৷ সী মাই কনডিশন স্যার (আমি গরীব মানুষ স্যার, তবুও রোজ আমার বাড়ীতে চল্লিশ জনের পাতা পড়ে৷ আমার অবস্থা বুঝুন স্যার)৷ সাহেবরা বুঝলেন--- কালী ভটচাজ হয়তো একটু ঘাবড়ে গেছেন৷ তাই তাঁরা তাকে আশ্বস্ত করে বললেন---‘‘আপনার ঘাবড়াবার কিছু নেই৷ যা বলবার আছে ্বলুন৷ আপনি বাংলাতেই বলুন, আমাদের সঙ্গে দোভাষী৷’ আছে৷
আগেই লেছি, কালী ভট্চাজের মুখের ইংরেজির খই ফুটত৷ তাই বাংলাতে বলতে যাবে সে কোন দুঃখে! সে বললে--- ‘‘মালগাড়ী ষ্ট্যাণ্ডিং স্যার, মেলগাড়ী কামিং স্যার৷ আই রেড ফ্ল্যাগ স্যার৷ মাই এ্যাসিষ্টান্ট ষ্টেশন মাষ্টার রেড স্যার , মাই সিগন্যালার রেড, মাই খালাসী রেড৷ অল ওয়ের রেডে-রেডে রেড৷ আই সেড্ পই পই নট্ কাম, নট কাম৷ ইভেন দেন ট্রেন ঘ্যাচচাং (মালগাড়ী ইষ্টিশনে দাঁড়িয়ে ছিল! মেলগাড়ী দ্রুত বেগে আসছিল৷ আমি লাল ফ্ল্যাগ দেখিয়েছিলুম৷ আমার সহকারী ষ্টেশন মাষ্টার লাল ফ্ল্যাগ দেখিয়েছিল আমার সহকারী ষ্টেশন মাষ্টার লাল পতাকা, আমার সিগন্যালার লাল পতাকা, আমার খালাসী লাল পতাকা দেখিয়েছিল--- প্ল্যাটফরম লালে লাল হয়ে গেছল৷ আমি পই পই করে ললুম--- এসো না, এসো না, এসো না৷ তা সত্ত্বেও মেলগাড়ীটা এসে জোরে ধাক্কা দিল)৷
সাহেবরা বলে গেলেন কালী ভট্চাজ নির্দোষ আর এমন সুন্দর ইংরেজী-জানা লোক ব্রিটিশ সরকারের একটি মূল্যবান সম্পদ৷ এঁকে রেলে না রেখে নমিনেটেড (মনোনীত) আই, সি,এস করে দেওয়া হোক৷
কালী ভট্চাজ তখন কাশীতে৷ ঠাকুরদারও ঠাকুরদা থাকেন৷ তাই কালী ভট্চাজেরও ওপরওলা ছিলেন৷ এ্যাদ্দিন কালী ভট্চাজের শে সুখে শান্তিতেই দিন কাটছিল৷ দরকার মত ৮/১০ দিন ছুটি না নিয়েও সে গরহাজির থাকত৷ কখনও কখনও বা কোটটা চেয়ারে গলিয়ে রেখে দিয়ে বাড়ী চলে যেত৷ চাপরাসীকে বলে যেত, সার্হে এলে লবি, উনি বাথরুমে গেছেন৷ সেই ফাঁকে তুই আমাকে বাড়ী থেকে ডেকে আনবি৷ কালী ভট্চাজের যাঁরা ওপরওলা আসতেন তাঁরা সবাই ছিলেন লালমুখো খাঁটি সাহেব৷ তাই ছুটি-ছাটায় তার কোন অসুবিধা হত না৷ কারণ ওই সব সাহেবরা এদেশের রীতি-নীতি রশম-রিবাজ কিছুই জানতেন না৷ কালী ভট্চাজ যা বলত ওঁরা তা-ই বেদবাক্য ্বলে মেনে নিতেন৷ কিন্তু চিরদিন কারো সমান যায় না৷ কালী ভট্চাজের ওপরওলা হয়ে এলেন একজন দেশী সাহেব৷ তিনি এদেশের ঘোঁৎ ঘাঁৎ সই জানতেন ৷ একবার তিনি অফিসে কালী ভট্চাজের খোঁজ নিতে এসে দেখলেন কালী ভট্চাজ অনুপস্থিত৷ পাত্তনিক করণিককে(establishment clerk) জিজ্ঞেস করে জানলেন, অফিসে তাঁর ছুটির কোন আবেদন পত্র নেই ৷ তখন তিনি কালী ভট্চাজের নামে কারণ দেখাবার হুকুমনামা (চার্জশিট) জারী করলেন৷ তারপর তিনদিন সব চুপচাপ৷ কালী ভটচাজের এ তিনদিনে দাড়ি একটু বেড়ে গেছে৷ সেই সময়টিতে খালি পায়ে কালী ভট্চাজ এসে হাজির৷ বলা বাহুল্য চার্জশীটের কথা সে লোকপ্রমুখাৎ আগেই শুণে নিয়েছিল কিন্তু স্পষ্টভাবে শোণেনি৷ সে অফিসে পৌঁছোবার সঙ্গে সঙ্গে পাত্তনিক করণিক তাঁকে সব ঘটনা খুলে ললে৷ কালী ভট্চাজের মহাগুরুনিপাতদশা দেখে সবাই বুঝতে পারলে , কেন কালী ভট্চাজ ম্লান মুখে শুকনো হাসি টেনে নিয়ে ললে---সাহেবের কী দোষ! আমার দুর্দৈবের কথা তো তিনি জানেন না৷ সঙ্গে সঙ্গে কালী ভট্চাজ একটা দরখাস্ত লিখে ফেলল৷ দরখাস্তের বাংলা অনুবাদ কতকটা এইরকম ঃ
মহাশয়,
যথাবিহিত সম্মানপুরঃসর এই সেবক নিবেদন করিতেছে যে, আমি শান্তিপুরের এক কুলীন ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান৷ আমার পিতামহ শতরথ ভট্টাচার্য মহাশয়ের একশতটি পত্নী ছিলেন৷ আমার পিতামহ বৎসরে প্রতি তিনদিন এক একটি পত্নীগৃহে প্রণামী লইবার জন্য যাইতেন৷ ইহাতে তাঁহার তিন শতদিন অতিবাহিত হইয়া যাইত৷ বৎসরের বাকী পঁয়ষট্টি দিন স্বগৃহে থাকিয়া প্রাপ্য প্রণামীর হিসাব নিকাশ ও চাষআবাদি দেখিতেন৷ আমার পিতামহ বহু পূর্বেই গঙ্গালাভ করিয়াছেন৷ পিতামহীরা কিস্তীবন্দী ভাবে একজন-দুইজন করিয়া তাঁহার পথ ধরিতেছেন৷ গত বৎসর মারা গিয়াছিলেন তিনজন, এবৎসর ইতোমধ্যেই পাঁচজন গত হইয়াছেন৷ এ বৎসর শীত একটু বেশী পড়িয়াছে বলিয়া সম্ভবতঃ অধিক সংখ্যায় তাঁহারা অন্যলোকে পাড়ি দিতেছেন৷ যাহাহউক মহাশয় , সত্যকথা নিবেদন করিলাম৷ এ পর্যন্ত আমার বাইশে জন পিতামহীর স্বর্গপ্রাপ্তি ঘটিয়াছে৷ অবশিষ্ট আটাত্তর জন এখনও মরিতে বাকী রহিয়া গিয়াছেন৷ (রীমেনিং সেবেন্টি এইট্ গ্রাণ্ডমাদারস্ আর ষ্টিল টু ডাই)৷
সাহেবের ওপর কালী ভট্চাজের অবদমিত ক্রোধ অর্থাৎ রোষ ছিল৷ সে এই বুদ্ধিমত্তার দ্বারা সাহেবের বিরুদ্ধে উপযুক্ত প্রতিশোধ নিলে৷ তবে বাইরে তাকে কাছা নিয়ে কয়েকদিন ঘোরাঘুরি করতে হয়েছিল৷ এই যে অবদমিত ক্রোধ বা রোষ এর জন্যে ‘র’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে৷