প্রাউটের অর্থনীতি–ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

প্রাউটের অর্থনীতি–ব্যবস্থার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যের ওপর নিম্নে আলোকপাত করা হচ্ছে ঃ

নূ্যনতম প্রয়োজন ও ক্রয়ক্ষমতার গ্যারান্টী ঃ

প্রাউট প্রতিটি মানুষকে জীবন–ধারণের নূ্যনতম প্রয়োজন–অন্ন, বস্ত্র, আবাস, চিকিৎসা ও শিক্ষা–প্রদানের নিশ্চিততার (গ্যারান্টী) পক্ষপাতী৷ নূ্যনতম প্রয়োজনপূর্তির গ্যারান্টী দানের পর যে উদ্বৃত্ত সম্পদ থাকবে তা যাঁরা বিশেষ দক্ষতার অধিকারী বা বিশেষ গুণ–সম্পন্ন যেমন চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়র বৈজ্ঞানিক প্রভৃতির মধ্যে বন্টন করতে হবে, কারণ সমাজের সামূহিক উন্নয়নে এঁদের বিশিষ্ট ভূমিকা রয়েছে৷

মানুষের এই নূ্যনতম প্রয়োজনের পরিমাণ প্রগতিশীলভাবে বৃদ্ধি করে যেতে হবে যাতে সাধারণ মানুষের জীবনধারণের মানের ক্রমোন্নয়ন ঘটতে পারে৷ সমবন্টনের তত্ত্ব একটা অলীক কল্পনা ও এটি সরল জনসাধারণকে প্রবঞ্চিত করার এক চাতুর্যপূর্ণ স্লোগান মাত্র৷ প্রাউট এ তত্ত্বকে বর্জন করে অর্থনৈতিক সম্পদের যুক্তিসঙ্গত বন্টন–নীতি দিয়েছে৷ এই ব্যবস্থা উৎপাদন–বৃদ্ধির জন্যে ইনসেনটিব (আর্থিক বা অনুরূপ উৎসাহ) প্রদান করবে৷ এই নীতির বাস্তবায়নের জন্যে প্রতিটি ব্যষ্টির প্রগতিশীলভাবে ক্রয়ক্ষমতা–বৃদ্ধিতে প্রাউটের অর্থনীতির চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে৷ কারণ আজ বিশ্বের বহু অনুন্নত, উন্নয়নশীল ও উন্নত দেশে জনসাধারণের ক্রয়ক্ষমতাকে অবহেলা করায় তাদের অর্থনৈতিক–ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ছে ও ঘনিয়ে আসছে দারুণ সংকট৷ সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্যে প্রথমে শৌখিন দ্রব্যকে গুরুত্ব না দিয়ে জীবনধারণের অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের সর্বাধিক উৎপাদন করতে হবে৷ এই ব্যবস্থা উৎপাদন ও ভোগের মধ্যে সমতা আনবে ও জনসাধারণের প্রয়োজনপূর্ত্তির নিশ্চিততা আনবে৷

সমবায় ব্যবস্থা ঃ

প্রাউটের মতে পণ্যের উৎপাদন ও বন্টনের ব্যাপারে যতগুলো ব্যবস্থা আছে সমবায় হ’ল তার মধ্যে সর্বোত্তম ব্যবস্থা৷ নীতিবাদের দ্বারা পরিচালিত সমবায়ই ধনতান্ত্রিক ও অন্যান্য শোষণ থেকে মানুষকে মুক্ত করতে পারে৷ সমবায়–ব্যবস্থায় দালাল বা ফড়েদের কোন ভূমিকা থাকে না৷ বর্ত্তমান বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সমবায় ব্যবস্থা যে সফলতা অর্জন করতে পারছে না তার কারণ পুঁজিবাদী শোষকরা তাদের শোষণ কায়েম রাখার জন্যে ব্যাপক দুর্নীতির জাল বিস্তার করে রেখেছে৷

সমবায় প্রতিষ্ঠান সাধারণতঃ গড়ে ওঠে সেই জনমণ্ডলীর মিলিত শ্রমে ও বুদ্ধিতে, যে জনমণ্ডলী একই অর্থনৈতিক কাঠামোয়, একই প্রয়োজনের তাগিদ নিয়ে বাস করছে ও সমবায়িক ভিত্তিতে উৎপন্ন বস্তুর বাজারও হাতের কাছে পাচ্ছে৷ উল্লিখিত তিনটি তত্ত্বের একত্র সমাবেশ না হলে সমবায়ের বিকাশ হতে পারে না৷ ঠিকভাবে পরিচালিত হলে সমবায়–ব্যবস্থা ব্যষ্টিগত মালিকানার সমস্ত ত্রুটি থেকে মুক্ত হবে ও বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতির দ্বারা এতে উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধিও সম্ভব হবে৷

সমবায়–উদ্যোগের সফলতা নির্ভর করে তিনটি তত্ত্বের ওপর ঃ নৈতিকতা, শক্তিশালী প্রশাসন ও জনসাধারণ কর্ত্তৃক সমবায়কে মনপ্রাণ সহকারে গ্রহণ৷ এই তিনটি তত্ত্বের সমন্বয় যে অনুপাতে বৃদ্ধি পাবে তার ওপর নির্ভর করবে সমবায়ের সাফল্যের মাত্রা৷ জনসাধারণকে সমবায় গড়তে উৎসাহ প্রদানের জন্যে–আদর্শ সমবায় উদ্যোগ গড়তে হবে ও সমবায় ব্যবস্থার উপকারিতা সম্পর্কে মানুষকে শিক্ষিত করে তুলতে হবে৷ সমবায়ের উৎপাদন ও বন্টন উভয় ক্ষেত্রেই সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করতে হবে৷ যথাযথ আধুনিকীকরণ উৎপাদনের বৃদ্ধি ঘটাবে৷

সমবায়–ব্যবস্থায় ম্যানেজার নির্বাচন করতে হবে তাদের মধ্যে থেকে যাদের সমবায়ে শেয়ার আছে৷ কোন কৃষি–সমবায়ে সদস্যরা তাদের লভ্যাংশ পাবেন দু উপায়ে–প্রথমতঃ সেই সমবায়ে তাঁরা যে পরিমাণ জমি দান করেছেন তার ওপর ভিত্তি করে, দ্বিতীয়তঃ উৎপাদনের জন্যে তাঁরা কতটা কায়িক বা মানসিক শ্রম দান করেছেন তার ওপর ভিত্তি করে৷ লভ্যাংশ বিতরণের সময় উৎপাদিত দ্রব্যকে প্রথমে আধাআধি (৫০ক্ম–৫০ক্ম) ভাগ করতে হবে৷ তৎপরে প্রথমে ৫০ শতাংশ শ্রমের ভিত্তিতে ও দ্বিতীয় ৫০ শতাংশ জমির ভিত্তিতে বিতরণ করতে হবে৷

একটা বিশেষ কোন অঞ্চলের পরিবর্ত্তে সমস্ত অঞ্চলের উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে ও স্থানীয় সম্পদও সম্ভাবনাগুলোকে উন্নয়ন–প্রকল্পে কাজে লাগাতে হবে৷ এই ভাবে সমবায়–উদ্যোগের উন্নয়নে স্থানীয় জনসাধারণের অংশগ্রহণে অগ্রাধিকার দিতে হবে৷

প্রাউট কৃষি–সমবায় গড়ে তুলে পর্যায়ক্রমে ভূমির সামাজিকীকরণের মাধ্যমে বিতর্কিত ভূমি–মালিকানা সমস্যার সমাধান দিয়েছে৷ স্থানীয় এলাকার অর্থনৈতিক অবস্থার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ধাপে ধাপে এই সামাজিকীকরণকে বাস্তবায়িত করতে হবে৷ এই পদ্ধতি চলাকালীন কোন নির্দিষ্ট ব্যষ্টি বা গোষ্ঠীর হাতে ভূমির মালিকানা থাকা উচিত নয়৷

(ক্রমশঃ)