উত্তরপূর্বাঞ্চলের বাঙালীদের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের সময় আগত

লেখক
তপোময় বিশ্বাস

ভারতবর্ষে বাঙালীদের নিজস্ব রাজ্য শুধু ‘পশ্চিমবঙ্গ’ এই ভুল ধারণা অনেকেই পোষণ করে থাকেন৷ ইতিহাস বলছে, পশ্চিমবঙ্গ ব্রিটিশ পূর্ব ভারতের অখণ্ড বাঙলার একটি খণ্ডিত অংশমাত্র৷ ব্রিটিশ রাজশক্তি ক্ষমতার অপব্যবহার করে অখণ্ড বাঙলাকে টুকরো টুকরো করে প্রাকৃতিক সম্পদে  পরিপূর্ণ অংশগুলিকে অবাঙালী অধ্যুসিত অঞ্চলের সঙ্গে সংযুক্তি করে সেই অঞ্চলের ওপর প্রবলভাবে অর্থনৈতিক সম্পদের লুঠপাঠ করতে থাকে৷ সেই লুঠপাটকে দীর্ঘস্থায়ী ও তৎকালীন ভারতে বাঙালীদের শোষণবিরোধী বৈপ্লবিক কর্মধারা থেকে বিরত করতে অবাঙালী অঞ্চলের বহিরাগতদের সঙ্গে ভূমিপুত্র বাঙালীদের বিরোধ বাধিয়ে রাখে৷ বর্তমানেও ব্রিটিশদের উত্তরসূরি দেশীয় সাম্রাজ্যবাদের মদতপুষ্ট রাজনৈতিক দলগুলি একই পথে পা মিলিয়ে চলছে৷

অখণ্ড বাঙলা থেকে কেটে নেওয়া অঞ্চলগুলির মধ্যে ভারতের উত্তরপূর্বের রাজ্যগুলি অসম-ত্রিপুরা-মণিপুর মেঘালয়ের বাঙালীদের প্রতি চরম বঞ্চনা-লাঞ্ছনার এক নিদারুণ নির্মম সত্য তুলে ধরছি৷ অসম-নাগরিকত্ব, এন.আর.সি, ডিটেনশনক্যাম্প, সি এ.এ ইত্যাদির প্রসঙ্গে এই অসম প্রদেশের নাম বারংবার শিরোনামে উঠে এসেছে৷ নাগরিকত্ব হারাবার ভয়ে বাঙালীদের আত্মহত্যার ঘটনা অসমে প্রায়শই ঘটে৷ ডিটেনশনক্যাম্প নামক মধ্যযুগীয় বর্বরতার শিকার হচ্ছেন অসমের শতশত বাঙালী৷ সম্প্রতি  কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের দশম শ্রেণী পর্যন্ত হিন্দী চালুর ঘোষণার পরেই, সেই ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছেন অসমের শিক্ষামন্ত্রী রণোজ পেগু৷ শুধু হিন্দী চালু করা নয়, এরসঙ্গে অসমের ঐতিহ্যশালী বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়গুলিকে বন্ধ করে বা সেগুলিকে অসমীয়া মাধ্যমে পরিণত করার ব্যাপারে অসম সরকার পুরোদস্তুর নেমে পড়েছে৷ রাঙ্গিয়ায় ৭৩ বছরের পুরনো ঐতিহ্য বহন করা বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়কে অসমীয়া মাধ্যমে পরিণত করার বিজ্ঞপ্তি জারি হয়েছে৷ গুয়াহাটির পল্টন বাজারের শতাব্দী প্রাচীন বাংলা মাধ্যম স্কুলটিকেও বন্ধ করে দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে৷ লামডিঙের বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয় গুলিকে পূর্বেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে৷

নাগরিকত্ব-শিক্ষা-চাকরি সহ সর্বক্ষেত্রে আজ উত্তর-পূর্বের বাঙালীরা বঞ্চনার শিকার৷ ১৯৬১ সালের ১৯শে মে’র একাদশ বাংলা ভাষা শহীদদের রক্তে অর্জিত-বাংলা ভাষা সরকারি ভাষা৷ তবুও পরিকল্পিতভাবে সরকার হিন্দী - হিন্দু-হিন্দুস্থানের তাস খেলে উগ্র অসমীয়া ভাবপ্রবণতাকে উৎসাহিত করে বাঙালী-অসমীয়া বিদ্বেষ খেলে শোষণ জারি রাখার কুমতলব করে চলেছে৷ বাংলা ভাষা অসমের স্বীকৃত সরকারি ভাষা হওয়া সত্ত্বেও প্রতিনিয়ত অসমের বাঙালীদের মুখের ভাষা কেড়ে তাদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পর্যবসিত করার নীলনকসা আঁকা হচ্ছে৷

উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মনিপুরে ইনারলাইন পারমিটের নামে তীব্র বাঙালী বিদ্বেষী, বিচ্ছিন্ন মনোভাবের আত্মপ্রকাশ আমরা দেখছি৷ মেঘালয়ে যখন-তখন বাঙালীদের ঘর-বাড়ি বসতি জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে, যত্রতত্র প্রকাশ্য দিবালোকে বাঙালীদের খুন করা হচ্ছে৷ বাঙালী অধ্যুষিত ত্রিপুরাতে বাঙালীদের ওপর শোষণ চরমভাবে চলছে৷ সরকারের পরোক্ষ মদতেই (বিভিন্ন নীতি প্রয়োগ) সেখানে উপজাতি -জনজাতিদের সঙ্গে বাঙালীদের মধ্যে লড়াই লাগিয়ে কৃত্রিম সামাজিক-রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরী করে  প্রবলভাবে অর্থনৈতিক সম্পদের লুঠপাট চালানো হচ্ছে৷ বাঙালীদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চনার এই করুণ চিত্র মানবতাবিরোধী৷

বাঙালী জনগোষ্ঠীর ভাগ্যাকাশে কি এইরকমের দুর্গতি থাকার কথা? বিদেশী, ডি-ভোটার, বাংলাদেশীর মতন অপমানসূচক শব্দ শোনবার জন্যই কি এই বাঙালী জনগোষ্ঠী ভারতবর্ষের স্বাধীনতা মুক্তি আন্দোলনে নির্ভয়ে, নিঃসংকোচে আত্মবলিদান করেছিল? ক্ষুদিরাম বসু, বিনয়-বাদল-দীনেশ, মাস্টারদা সূর্য সেনের মতন শতশত বাঙালী ছাত্র-যুব এই বঞ্চনার জন্যই হাসি মুখে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন? নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু কি এই জন্যই সর্বত্যাগ করে স্বাধীনতার সাধনায় নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন?

অসমীয়া, মণিপুরী, জনজাতি, উপজাতি বা কেউই বাঙালীদের শত্রু নয়৷ বাঙালীদের শত্রু হচ্ছে, সাম্রাজ্যবাদীশক্তির মদতপুষ্ট ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলির বিভাজন নীতি, বাঙালী বিদ্বেষী পরিকল্পনা তথা কার্যকলাপ৷ এই হিন্দী, সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে উত্তরপূর্বাঞ্চলের বাঙালীদের হাতে হাত, কন্ঠে কন্ঠ মিলিয়ে  নিজেদের অধিকার ছিনিয়ে নিতে হবে৷ বাঙালী ভীতু-কাপুরুষের মতন মরবে না, বীর বাঙালী লড়াই করে নিজের ন্যায্য অধিকার ছিনিয়ে নেবে ৷ নেতাজীর ভাষায়-স্বাধীনতা ভিক্ষা করে পাওয়া যায় না, স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিতে হয়৷ হিন্দী সাম্রাজ্যবাদী শোষকের বিরুদ্ধে লড়াই করে বাঙালী তার ভাগ্যাকাশে নতুন সূর্য উদয় করবেই করবে৷ বাঙালীদের এই লড়াই সাম্রাজ্যবাদী শোষকের বিরুদ্ধে লড়বার প্রেরণা ভারত তথা বিশ্বের অন্যান্য জনগোষ্ঠীকেও জোগাবে বলেই মনে করি৷