গণতন্ত্রের ঘাড়ে অনৈতিকতার ভূত

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

 

সম্পাদকীয়

গণতন্ত্র সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে--- জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্যে জনগণের সরকার৷ অর্থাৎ জনগণের দ্বারা নির্বাচিত, জনগণের কল্যাণের জন্যে, জনগণের সরকার৷ বর্তমান প্রচলিত শাসনতন্ত্রের মধ্যে গণতন্ত্রকে শ্রেষ্ঠ বলেও গণতন্ত্রের ত্রুটিগুলি তুলে ধরেছেন প্রাউট তত্ত্বের প্রবক্তা সর্বজন শ্রদ্ধেয় শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার৷ সার্থক গণতন্ত্রের প্রথম ও প্রধান শর্তই হলো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নাগরিকদের মধ্যে শতকরা ৫১জনকে শিক্ষিত হতেই হবে৷ তবে শিক্ষিত মানে শুধু পুঁথিগত বিদ্যা নয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে সচেতন হতে হবে৷ নতুবা স্বার্থলোলুপ ধুরন্ধর নেতারা ক্ষমতার শীর্ষে বসে জনগণের পিণ্ডি চটকাবে৷ বর্তমান ভারতবর্ষে গণতান্ত্রিক পরিবেশ কতকটা সেইরকম৷ ধনতন্ত্র নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রে সমাজ মানসিকতার কোনো স্থান নেই৷ তাহলে গণতান্ত্রিক সরকার কতটা জনগণের জন্য, জনগণের দ্বারা, জনগণের শাসন!

গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য হল সম্পূর্ণ শোষণমুক্ত সমাজ৷ অর্থাৎ প্রতিটি মানুষের নূ্যনতম প্রয়োজনপূর্তি৷ প্রতিটি মানুষের হাতে ক্রয়ক্ষমতা ও মানসিক আধ্যাত্মিক বিকাশের নিশ্চিততা থাকবে৷গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় দেশ কাল পাত্রের সঙ্গে সমান্তরালতা ও সামঞ্জস্য বজায় রেখেই তৈরী করতে হয় সামাজিক ও আর্থিক বিকাশের নীতি ও পরিকল্পনা৷ অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে প্রতিটি নাগরিকের জীবন যাপনের মান দিন দিন উন্নত হয়৷ তবেই প্রগতিশীল সমাজতন্ত্র সার্থক রূপ পাবে৷ স্বাধীনতার বহু আগে থেকেই ভারতের রাজনীতি ও রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থায় দেশীয় পুঁজিপতিদের কালো হাতের কারসাজি শুরু হয়৷ ১৯৩৮ সালে সুভাষচন্দ্র বলেছিলেন দেশীয় পুঁজিপতিরা ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে শক্তি জোগাচ্ছে৷ একথা বলার জন্যে সুভাষচন্দ্রে কী পরিণতি হয়েছে তা দেশবাসী জানে৷ ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগষ্ট মধ্যরাতে নেহেরুর বকলমে স্বাধীন ভারতের শাসনভার গ্রহণ করে ওই দেশীয় পুঁজিপতিরা৷ সেই দিন থেকেই স্বাধীন ভারতের অর্থনীতি প্রত্যক্ষভাবে ও রাজনৈতিক দলগুলির বকলমে দেশীয় পুঁজিপতিরাই রাষ্ট্রের শাসনভার নিয়ন্ত্রিত করছে৷ তাই স্বাধীনতার ৭৭ বছর পরেও সার্থক গণতন্ত্র অধরা থেকে গেল৷ সম্প্রতি এক আন্তর্জাতিক সংস্থার সমীক্ষায় প্রকাশ পেয়েছে ভারতীয় গণতন্ত্র স্বৈরাচারী পর্যায় রয়েছে৷

সফল গণতন্ত্রের আরও একটি শর্ত নৈতিকতা৷ যা ভারতীয় রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে বড়ই অভাব৷ শুধু রাজনৈতিক নেতা নন জনগণেরও কমপক্ষে একান্ন শতাংশকে নৈতিক অনুশাসনে কঠোরভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে৷ তবেই গণতন্ত্র সাফল্যের মুখ দেখবে৷ রাজনৈতিক দলের নেতারাই পরস্পরের বিরুদ্ধে কাদা ছোঁড়াছুড়ি করে গণতন্ত্রকে প্রহসন করে তুলেছে৷ নির্বাচনে কারচুপি, ভোটার লিস্টে কারচুপি, ভোট কেনা বেচা, পেশী বলের ভয় দেখিয়ে ভোট ছিন্‌তাই এসব অভিযোগ প্রতিটি দলই একে অন্যের বিরুদ্ধে করে থাকে৷ এক কথায় ভারতীয় গণতন্ত্রের ঘাড়ে অনৈতিকতার ভূত চেপে বসেছে ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগষ্ট মধ্যরাত থেকে৷ এরই প্রভাবে সাম্প্রদায়িকতা প্রাদেশিকতা জাতিভেদের মতো সংকীর্ণ নৈতিকতা বর্জিত কাজকর্ম বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রে প্রশ্রয় পাচ্ছে৷

বর্তমানে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের রাজনৈতিক নেতাদের আচরণে কথায় বার্র্তয় শালিনতা বোধও লোপ পাচ্ছে৷ মহিলাদের উদ্দেশ্যেও অসম্মানজনক উক্তি করে বসছেন কোনো কোনো নেতা৷ এই নিয়ে তারা গর্ববোধও করছে,আবার নির্বাচনে দাঁড়িয়ে জয়লাভও করছে৷ আসলে জনগণের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক চেতনার অভাবের সুযোগ নিয়ে ধূর্ত চতুর ও ধুরন্ধর অনৈতিক নেতারা নির্বাচনে জিতে রাষ্ট্রপরিচালনার শীর্ষাসনে বসে যাচ্ছে৷ এড়াই গণতন্ত্রের বেদীকে মসিলিপ্ত করছে৷ সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধেও অশালীন শব্দ ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে৷ গণতন্ত্রের ঘাড় থেকে এই অনৈতিকতার ভূত নামাতে না পারলে সার্থক গণতন্ত্র অধরাই থেকে যাবে৷