গুরু তিন প্রকারের, শিষ্যও তিন প্রকারের৷ মানুষের অভিব্যক্তিও তিন প্রকারের, বৈদ্যকেও তিন প্রকারের বলা হয়ে থাকে৷ অধম বৈদ্য তিনি, যিনি কেবল ওষুধ বলে দেন, মধ্যম বৈদ্য তিনি যিনি ওষুধ তো বলেই দেন, সঙ্গে সঙ্গে এটাও জেনে নেন যে রোগী সেটা ব্যবহার করতে পারবে কী না৷ যিনি উত্তম বৈদ্য তিনি ওষুধও বলে দেন, জেনেও নেন, আর সঙ্গে সেটা ব্যবহারের ব্যবস্থাও করে দেন৷ অধম ও মধ্যম স্তরের বৈদ্য বস্তুতঃ বৈদ্য নয়, কেবল উত্তম স্তরের বৈদ্যই বাস্তবিক বৈদ্য৷ সেই রকমই অধম স্তরের গুরু ভাল ভাল কথা শুণিয়ে দেন৷ মধ্যম স্তরের গুরুও ভাল কথা শুণিয়ে দেন, আবার তার সম্বন্ধে জেনেও নেন৷ উত্তম স্তরের গুরু ভাল কথা শুণিয়ে দেন, জিজ্ঞেস করে নেন, আর শিষ্যকে উন্নত প্রকৃতির মানুষ তৈরী করার জন্যে প্রয়োজন হলে তাকে দণ্ডও দেন৷ উত্তম স্তরের গুরুই গুরু, অধম মধ্যম স্তরের গুরু গুরু নন৷
শিষ্যের মধ্যে অধম কোটির শিষ্যকে ‘‘অধোমুখ পয়োকুম্ভ’ বলা হয়৷ অধোমুখ কুম্ভকে জলে ডুবিয়ে দিলে সেটা জলে ভরে যায়৷ যতক্ষণ জলে আছে, ভর্তি হয়ে আছে কুম্ভটিকে জল থেকে তুলে নিলে কুম্ভ খালি হয়ে যায়, জল যেখানে ছিল সেখানেই পড়ে যায়৷ মধ্যম কোটির শিষ্য ‘‘উৎসঙ্গ বদরী’৷ কুল গাছে কাঁটা থাকে৷ কষ্ট করে গাছে উঠে কুল পাড়ল, কিন্তু নামার সময় কাঁটা বাঁচিয়ে নামার চেষ্টায় সব কুল নীচে পড়ে গেল৷ অর্থাৎ মধ্যম স্তরের শিষ্য প্রতিকূল পরিস্থিতি থেকে জ্ঞান আহরণ করে কিন্তু রক্ষা করার ব্যবস্থা করে না৷
উত্তম স্তরের শিষ্য ‘ঊর্ধ্বমুখ পয়োকুম্ভ’ সদৃশ৷ এই কুম্ভকে জলে ডোবালে জল ভরে যায়, জল থেকে সরিয়ে নিলেও তাতে জল ভরাই থাকে৷ উত্তম স্তরের শিষ্য গুরুর কাছে শোণে, যা শোণে তা ৰুঝে নেয়, আর তা জীবনে প্রয়োগ করে৷
মানুষের অভিব্যক্তিও তিন প্রকারের–জাগতিক, মানসিক আর আধ্যাত্মিক৷ যেখানে অর্থ–সামর্থ্য ইত্যাদির বাহ্যিক প্রদর্শন ঘটে, সেটাই হল জাগতিক অভিব্যক্তি৷ এইক্ষেত্রে যে প্রতিষ্ঠা প্রাপ্ত হয় সেটা জলরেখাবৎ৷ জলরেখা যেমন তক্ষুনি জলেই মিলিয়ে যায়, জাগতিক ক্ষেত্রের প্রতিষ্ঠার দশাও সেই রকমই হয়৷ অতএব ৰুদ্ধিমান মানুষ জাগতিক ক্ষেত্রের প্রতিষ্ঠার জন্যে প্রয়াস করবে না৷ মানসিক ক্ষেত্রের প্রতিষ্ঠা ‘‘বালুরেখাবৎ’৷ বালির ওপর রেখা টানলে, বাতাসের এক ঝটকা সেই রেখাকে শেষ করে দিল৷ সেই রকম ৰৌদ্ধিক জগতে প্রতিষ্ঠাও ব্যর্থ হয়ে যাবে৷
আধ্যাত্মিক সাধক প্রতিষ্ঠা চায় না৷ তাদের প্রতিষ্ঠা হ’ল অনন্তকালের জন্যে পরমপুরুষে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়া৷ এই প্রতিষ্ঠা হ’ল শীলারেখাবৎ৷ ৰুদ্ধিমান মানুষ জাগতিক বা মানসিক প্রতিষ্ঠার পিছনে দৌড়বে না৷ তারা আধ্যাত্মিক প্রতিষ্ঠার জন্যে সচেষ্ট হবে, যাতে করে তারা পরমপুরুষে অনন্তকাল প্রতিষ্ঠিত হয়েথাকতে পারে৷ এটাই মানুষের ধর্ম৷
২৩ অক্টোবর ১৯৭১