মহাসম্ভূতি শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজীর জীবনী ও আদর্শ

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূত

আনন্দমার্গের প্রতিষ্ঠাতা ধর্মগুরু শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী পিতৃপ্রদত্ত নাম শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার৷ পিতার নাম শ্রীলক্ষ্মীনারায়ণ সরকার ও মাতার নাম শ্রীমতী আভারাণী সরকার৷ ১৯২১ সালের বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে সকাল ৬টা ৭মিনিটে বিহারের মুঙ্গের জেলার অন্তর্গত জামালপুর শহরে শ্রীপ্রভাতরঞ্জন জন্মগ্রহণ করেন৷ অবশ্য তাঁর পৈত্রিক বাসভূমি ছিল বর্ধমান জেলার বামুনপাড়া গ্রামে৷ বর্ধমান শহর থেকে মাইল সাতেক দক্ষিণপূর্বে ও বর্ধমানহাওড়া রেলপথের শক্তিগড় রেলষ্টেশনের মাইল তিনেক পশ্চিমে এই বামুনপাড়া গ্রাম৷ শ্রীপ্রভাতরঞ্জনের পিতৃদেব শ্রীলক্ষ্মীনারায়ণ সরকার জামালপুর রেলওয়ে ওয়ার্কশপে অ্যাকাউণ্ঢ্যান্ট হিসেবে চাকুরিতে যোগদান করেন৷ সেই সূত্রেই সরকার পরিবার জামালপুরে আসে৷

১৯২৭ সাল থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত শ্রীপ্রভাতরঞ্জন জামালপুরে কেশবপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোণা করেন৷ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে ১৯৩১ সালে এখানকার ইষ্ট ইণ্ডিয়ান রেলওয়ে হাইস্কুলে ভর্ত্তি হন৷ পড়াশোণায় তিনি সব বিষয়েই অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন৷ তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল অসাধারণ৷ তাঁর এক সহপাঠী পুরোনো দিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, বিশেষ করে ভূগোলে তাঁর ছিল অসাধারণ দখল৷ সারা পৃথিবীর পাহাড়পর্বত, নদনদী, কোথায় গঙ্গাব্রহ্মপুত্রের উৎস, কোথায় মিসিসিপি, আমাজন নদীর উৎসস্থল, কোন্ নদী কতটা চওড়া, কতটা দীর্ঘ, কোন্ কোন্ ভূখণ্ডের মধ্য দিয়ে বয়ে চলে গেছে, প্রভাতরঞ্জন গড় গড় করে সব বলে দিতে পারতেন৷ আর ওঁর এ বিষয়ে দখল এতটা ছিল যে, মাঝে মধ্যে ভূগোলের শিক্ষক অনুপস্থিত থাকলে প্রধান শিক্ষক ভবানীচরণ মিত্র প্রভাতরঞ্জনকে ভূগোলের ক্লাশ নিতে বলতেন৷ ইংরেজী, সংস্কৃত, বাংলা ও উর্দুতেও ছিল ওঁর অসাধারণ দখল৷ অঙ্গিকা, ভোজপুরী, মৈথিলী প্রভৃতি উত্তর ভারতীয় প্রায় সমস্ত ভাষাগুলি উনি স্বচ্ছন্দে বলতে পারতেন৷

ছাত্রাবস্থায় পড়াশোণার ক্ষেত্রে মেধাবী ছাড়াও শ্রীপ্রভাতরঞ্জন ছিলেন সদাচারী, মিতভাষী, স্পষ্টবক্তা, সত্যবাদী ও অত্যন্ত শৃঙ্খলা পরায়ণ৷ ১৯৩৯ সালে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করেন৷ এরপর মাতুল শরৎচন্দ্র বসু শ্রীপ্রভাতরঞ্জনকে কলকাতায় বিদ্যাসাগর কলেজের বিজ্ঞান বিভাগে ভর্ত্তি করে দেন৷ ১৯৪১ সালে শ্রীপ্রভাতরঞ্জন বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে আই. এস. সি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন৷

ইতোপূর্বে ১৯৩৬ সালে শ্রীপ্রভাতরঞ্জনের পিতৃদেব শ্রীলক্ষ্মীনারায়ণ সরকার মারাত্মক কালাজ্বরে আক্রান্ত হয়ে পরলোক গমন করেন৷ তিনি ছিলেন পরিবারটির অভিভাবক ও একমাত্র উপার্জনক্ষম পুরুষ, জ্যেষ্ঠপুত্র প্রভাতরঞ্জন তখন নবম শ্রেণীর ছাত্র৷ সেই পরিস্থিতিতে মাতা আভারাণী সরকার শক্ত হাতে সংসারের হাল ধরেন ও সন্তানরা যাতে লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারে সেদিকে সচেষ্ট হন৷ শ্রীমতী আভারাণী সাহসিকতার সঙ্গে পারিবারিক সমস্যা মোকাবিলা করছেন দেখে আত্মীয় স্বজন ও শুভানুধ্যায়ীরা পরিবারটির সাহায্যার্থে এগিয়ে আসেন৷

আই. এস. সি. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর ১৯৪১ সালে জামালপুরে ফিরে এসে পরিবারের আর্থিক সমস্যার কারণে তিনি রেলওয়ে বিভাগে চাকুরীর জন্যে আবেদন করেন ও চাকুরী পেয়েও যান৷ পিতৃদেব লক্ষ্মীনারায়ণ সরকার যে অফিসে কাজ করতেন ওই অফিসেই এ্যাকাউণ্ঢস্ বিভাগে তিনি নিযুক্ত হন৷ শুরু হয় শ্রীপ্রভাতরঞ্জনের কর্মজীবন৷

এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, বাল্যকালে ও কৈশোরে শ্রীপ্রভাতরঞ্জনের পড়াশোনার সঙ্গে সঙ্গে অতি সঙ্গোপনে সমান্তরালভাবে এগিয়ে চলছিল তাঁর রহস্যময় আধ্যাত্মিক জীবন৷ তাঁর পারিবারিক লোকজনের কাছে জানা যায়, প্রভাতরঞ্জন বাল্য অবস্থা থেকেই ঘর বন্ধ করে ধ্যান করতেন৷ অথচ তাঁর কোনো দীক্ষাগুরু বা আধ্যাত্মিক গুরু ছিল না৷

শিশুকাল থেকেই তাঁর জীবনে নানান ঐশী শক্তির প্রকাশ দেখা যায়৷ যেমন প্রভাতরঞ্জনের (ডাক নাম ছিলবুবু) বয়স তখন ছিল চার বছর৷ শিব চতুর্দশীর দিন তাঁর দিদি উপবাস ব্রত পালন করে সন্ধ্যেবেলা বুবুকে নিয়ে স্থানীয় শিবমন্দিরে পূজো দিতে গেছেন৷ মন্দিরে গিয়ে বুবু জোরে জোরে শিবের দীর্ঘ ধ্যানমন্ত্র ওঁ ধ্যায়েন্নিত্যং মহেশং রজতগিরিনিভং চারুচন্দ্রাবতংসম্.....নির্ভুল উচ্চারণে আবৃত্তি করে গেল৷ পুরোহিত সহ সবাই অবাক, অথচ এ মন্ত্র কেউ তাকে শেখায় নি৷ এ ব্যাপারে প্রশ্ণ করতেও বুবু কিছুই বলল না৷ ...এমনি অনেক ঘটনা রয়েছে৷

জামালপুরের পূর্বে কালীপাহাড়৷ সমান্তরাল কয়েকটি পাহাড়৷ দুই পাহাড়ের মধ্যে উপত্যকা৷ যা ডেথ ভ্যালী নামে পরিচিত৷ পাহাড়ের গায়ে ঘন জ৷ল৷ সবাই এই এলাকাতে যেতে দারুণ ভয় করত৷ অথচ, এটাই ছিল প্রভাতরঞ্জনের প্রিয় স্থান৷ এখানে তিনি সন্ধ্যার পর অনেক রাত পর্যন্ত একা একা বেড়াতেন বা বসে থাকতেন৷ এখানে তাঁর ঘোরাফেরাকে কেন্দ্র করেও বহু অলৌকিক ঘটনা লোকমুখে প্রচারিত হত৷ এসব ব্যাপারে বাড়ীর কেউ বা আত্মীয় বন্ধুবান্ধব কিছু জিজ্ঞাসা করলে সমস্ত কিছু মিথ্যা গুজব বলে উড়িয়ে দিতেন৷ তবে, অনেক বাস্তব ঘটনা থেকে প্রভাতরঞ্জনের আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের বদ্ধমূল ধারণা হয়েছিল যে প্রভাত যে কোন মানুষকে দেখে তার ভূতভবিষ্যৎ বলে দিতে পারেন৷

শ্রীপ্রভাতরঞ্জন যখন কলকাতায় পড়াশোণা করতেন, থাকতেন বাগবাজারে মাতুলালয়ে৷ সেসময় কলকাতা এখনকার মত জমজমাট শহর ছিল না৷ গঙ্গার তীরে কাশীমিত্র ঘাট ও আশপাশের নদীর তীর বরাবর অনেকখানি এলাকা তখন ছিল নির্জন, ঝোপঝাড়ে পরিপূর্ণ৷ সন্ধ্যায় নির্জন স্থানে বেড়ানো প্রভাতরঞ্জনের বাল্যাবধি অভ্যাস৷

তখন ১৯৩৯ সাল৷ প্রভাতরঞ্জনের বয়স তখন ১৮ বৎসর৷ সেদিন ছিল শ্রাবণী পূর্ণিমা তিথি৷ সন্ধ্যার সময় শ্রীপ্রভাতরঞ্জন নির্জন স্থানে বেড়াতে বেড়াতে কাশীমিত্র ঘাটের কাছে একটা বটগাছের তলায় বসেছেন৷ এমন সময় একজন দুর্ধর্ষ প্রকৃতির মানুষ প্রভাতরঞ্জনের কাছে টাকাপয়সা যা কিছু আছে ছিনতাই করার উদ্দেশ্যে এগিয়ে বলে, ‘তোমার যা কিছু আছে আমাকে দাও৷প্রভাতরঞ্জন তখন নির্ভিকভাবে বলে, ‘কালীচরণ, আমি তোমার সব কিছু জানি৷ এখন তোমার যা কিছু আছে আমাকে দাও৷লোকটি প্রভাতরঞ্জনের কথা শুণে অবাক্ হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে৷ প্রভাতরঞ্জন তার সারা জীবনের কুকীর্ত্তি একের পর এক বলে যেতে থাকেন৷ পরিশেষে বলেন, কালীচরণ, এবার তুমি তোমার জীবনধারা পাল্টাও৷ লোকটি তখন যন্ত্রচালিতের মত প্রভাতরঞ্জনের নির্দেশে স্নান করে এসে প্রভাতরঞ্জনের সামনে নতজানু হয়ে বসলো৷ প্রভাতরঞ্জন তাকে আধ্যাত্মিক সাধনায় দীক্ষা দেন৷ কালীচরণের জীবনধারা সম্পূর্ণ বদলে যায়৷ পরবর্ত্তী কালে সংসার ত্যাগ করে সে সন্ন্যাসী হয়ে যায় নাম হয় কালিকানন্দ৷

১৯৪৭ সালে রেলওয়ে অফিসে চাকুরীতে যোগদান করার পর বিশিষ্ট ভবিষ্যৎবক্তা হিসেবে প্রথমে তাঁর সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে৷ কেউ কোন সংকটে পড়লে সঙ্গে সঙ্গে প্রভাতরঞ্জনের কাছে ছুটে আসত পরামর্শের জন্যে৷ তিনি তাদের ধর্মোপদেশ দিতেন৷ তাঁর পরামর্শমত চলে লোকে নানান সংকট থেকে উদ্ধার পেয়ে যেত৷ লোকের মধ্যে বিশ্বাস জাগল যে প্রভাতরঞ্জনের মধ্যে বিশেষ আধ্যাত্মিক শক্তি আছে৷ আগ্রহী মানুষদের তিনি সাধনা শেখাতেন৷

জামালপুর রেলওয়ে ওয়ার্কশপের পরে কালীপাহাড়ের ঠিক নীচেই ছিল গাছগাছালিতে ভরা বিস্তীর্ণ ময়দান৷ ওখানে একসময় ছিল জঙ্গল৷ একবার জনৈক ইংরেজ রেলওয়ে ফোরম্যান

ঘন জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসা এক বাঘের মুখোমুখী হয়ে যায়৷ বাঘে মানুষে অনেক ধস্তাধস্তি হওয়ার পর উভয়েরই মৃত্যু হয়৷ ময়দানে যে জায়গাটিতে বাঘে মানুষে এই অসম যুদ্ধ হয়েছিল সেটিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্যে সেখানে দুটি পৃথক পৃথক কবর তৈরী করা হয়৷ একটি বাঘের কবর, আর একটি ওই সাহেবের কবর৷ ওই সাহেবের কবরের পাশে ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়ে একটি স্মৃতিফলক রয়েছে৷

শ্রীপ্রভাতরঞ্জন ত্রিশের দশক থেকে শুরু করে ষাটের দশক পর্যন্ত নিয়মিতভাবে ওই নির্জন স্থানে ঘোরাঘুরি করার পর ওই বাঘের কবরটির ওপর বসতে পছন্দ করতেন৷ রেলে চাকুরী করার সময় প্রায় প্রতিদিনই তিনি অফিসের পরে সান্ধ্যকৃত্যাদি সেরে এই স্থানে বেড়াতে আসতেন৷ কখনও কখনও একা, কখনও  বা দুচার জনকে সঙ্গে নিয়ে এসে ওইখানে তাদের ধর্মতত্ত্ব ও অন্যান্য নানান্ বিষয়ে উপদেশ দিতেন৷ তিনি কখনও কখনও বিভিন্ন গভীর আধ্যাত্মিক তত্ত্ব আলোচনার পর আধ্যাত্মিক ডিমোনষ্ট্রেশনও দিতেন, যেমন, ‘সবিকল্প সমাধি, নির্বিকল্প সমাধি, কুলকুণ্ডলিনী শক্তির (মানুষের মধ্যে অন্তর্নিহিত সুপ্ত আধ্যাত্মিক শক্তি) জাগরণ, মানব শরীরে বিভিন্ন চক্রের অবস্থিতি প্রভৃতি৷ একজনকে ধ্যানাসনে বসিয়ে তাঁকে স্পর্শ করে তাঁর ওপর আধ্যাত্মিক শক্তির প্রয়োগ করতেন৷ আর এইভাবে তাঁকে বিভিন্ন আধ্যাত্মিক অনুভূতি প্রদান করতেন৷

এইভাবে ধর্মগুরু হিসেবে শ্রীপ্রভাতরঞ্জনের আত্মপ্রকাশ ঘটতে থাকে৷ তিনি মানুষকে বলতেন, এক অনাদি অনন্ত চৈতন্য সত্তাপরম ব্রহ্মই মানুষের একমাত্র আরাধ্য৷ পরম ব্রহ্ম সবার মধ্যে রয়েছেন৷ ব্রহ্ম সম্প্রাপ্তি অর্থাৎ ঈশ্বরলাভের জন্যে তীর্থে তীর্থে মন্দিরে মন্দিরে ঘোরার কোনো প্রয়োজন নেই৷ প্রয়োজন কেবল মনকে অন্তর্মুখী করে ঈশ্বরের ধ্যান করা৷ জাতপাতসম্প্রদায় বিভেদ তিনি আদৌ সমর্থন করতেন না৷ তাঁর কথায়, ‘সমস্ত মানুষের এক ধর্ম’’, মানুষ মানুষ ভাই ভাই, উঁচু কিংবা নীচু নাই’‘৷ কোনো প্রকার কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস, যুক্তি ও মানবতাবিরোধী বাহ্যিক আচার অনুষ্ঠানকে তিনি সমর্থন করতেন না৷ তাঁর সুস্পষ্ট অভিমত, যোগ ও তন্ত্রভিত্তিক আধ্যাত্মিক অনুশীলনের মাধ্যমেই  মানুষের মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটবে, এইভাবে মানুষ দেবত্ব ও পরিশেষে ব্রহ্মত্ব তথা পূর্ণত্ব অর্জন করবে৷

ধীরে ধীরে শ্রীপ্রভাতরঞ্জনের উদার আধ্যাত্মিক আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে ও তাঁর ঐশী শক্তির পরিচয় পেয়ে রেল অফিসের বহু কর্মী ও অফিসারসহ বহু শিক্ষিত মানুষ তাঁর কাছে আধ্যাত্মিক সাধনা শিখে নিয়মিত অভ্যাস করতে থাকেন৷

পূর্বে বলা হয়েছে, ১৯৪১ সালে শ্রীপ্রভাতরঞ্জন রেলওয়ে অফিসে চাকুরীতে যোগদান করেন৷ এই সময় থেকে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি ক্রমেই ঘোরালো হয়ে ওঠে৷ সারা পৃথিবী জুড়ে বেজে ওঠে বিশ্বযুদ্ধের দামামা৷ বস্তুতঃ বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই সারা বিশ্বের কি সামাজিক, কি অর্থনৈতিক, কি রাজনৈতিক, কি ধর্মীয়সর্বক্ষেত্রেই একটা বিপর্যয় শুরু হয়ে যায়৷ ১৯১৪ থেকে ১৯১৮ পর্যন্ত ১ম বিশ্বযুদ্ধ, ১৯১৭ সালে সোভিয়েট রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লব, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতা আন্দোলন, আবার ২য় বিশ্বযুদ্ধ, দেশে দেশে ঘন ঘন গণভ্যুত্থানএই সমস্ত ঘটনা দীর্ঘকালের সযত্নপোষিত সামাজিক, সাংস্কৃতি, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ধ্যান ধ্যারণার মূলে হেনেছিল এক বিরাট মুষলাঘাত৷ একদিকে বিবেকহীন ধনতান্ত্রিক শোষণ, অপরদিকে ভ্রান্ত মার্ক্সবাদ মানবজাতির ভাগ্যাকাশে এক অশনি সংকেত রূপে দেখা দিল৷ সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের অস্তিত্ব হল অস্বীকৃত, নীতি ও ধর্ম হল পদে পদে নিন্দিত, ধিকৃত৷ বিশ্বযুদ্ধে কেবল লক্ষ লক্ষ মানুষই হতাহত হয়নি, মানুষের সামাজিক মূল্যবোধ, ন্যায়, নীতি, সততা ও অন্যান্য শ্রেয়বোধগুলিও বুলেটের আঘাতে বিধ্বস্ত হয়৷ মানুষ ধীরে ধীরে পশুত্বের দিকে এগোতে থাকে৷

মানব সমাজের এই যুগ সন্ধিক্ষণে শ্রীপ্রভাতরঞ্জন উপলব্ধি করলেন, এখন সমাজে প্রয়োজন মস্তিষ্কের সঙ্গে হৃদয়ের সংযোগ সাধন৷ প্রয়োজন জাগতিক উন্নতির সঙ্গে আধ্যাত্মবাদের সমন্বয়, প্রয়োজন প্রাচ্যের ও পাশ্চাত্ত্যের চিন্তাধারার মিলন৷ এই পরিস্থিতিতে তিনি একথাই সবাইকে শোণাতে লাগলেনআজকের সমাজের সমস্ত প্রকার সমস্যার সমাধানের চাবিকাঠি হলSubjective approach through objective adjustment’— অর্থাৎ অন্তর্জগতে মানুষকে আত্মবিকাশের সাধনার মধ্যে দিয়ে মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটাতে হবে ও সঙ্গে সঙ্গে এক সুসামঞ্জস্যপূর্ণ ঘৃণাদ্বেষশোষণহীন্ মানবসমাজ গড়ে তোলার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে৷

দৃঢ় আত্মপ্রত্যয় নিয়ে তিনি বলতে লাগলেন, কেবলমাত্র এই আদর্শই বিশ্বযুদ্ধের আতঙ্ক থেকে মানুষকে বাঁচাতে পারবে৷ তিনি সংকল্প নিলেন, এই আদর্শকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেবেন, সারা বিশ্বের মানুষকে এই আদর্শে উদ্বুদ্ধ করে বিশ্বৈকতাবাদের প্রতিষ্ঠা করবেন৷

তাই, অফিসের কাজকর্মের সঙ্গে সঙ্গে শ্রীপ্রভাতরঞ্জন নিরলসভাবে তাঁর নূতন আদর্শের প্রচার করে চললেন৷ এক এক করে রেলওয়ে অফিসের বহু উচ্চপদস্থ কর্মচারী, সঙ্গে সঙ্গে দূর দূরান্ত থেকেও বহু শিক্ষিত মানুষ তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করলেন৷

১৯৫৫ সালে ১লা জানুয়ারী আন্তর্জাতিক নববর্ষ উপলক্ষ্যে শ্রীপ্রভাতরঞ্জন তাঁর সমস্ত শিষ্যদের তাঁর নিজের বাসভবনে ডাকলেন৷ সেখানে তিনি তাঁর নব প্রবর্তিত আদর্শের নাম দিলেন–‘আনন্দমার্গ৷ তিনি বললেন, প্রতিটি মানুষ সুখ চায়, সীমিত সুখ নয়, অনন্ত সুখ৷ সীমিত সম্পদ থেকে মানুষ পায় সীমিত সুখ, কিন্তু তাতে অনন্ত সুখ অর্থাৎ অন্তরের স্থায়ী প্রশান্তি লাভ করা যায় না৷ একমাত্র অনন্ত সম্পদ থেকেই অনন্ত সুখ পাওয়া যেতে পারে৷ আর, ব্রহ্ম ছাড়া অন্য কিছুই অনন্ত নয়৷ তাই একমাত্র ব্রহ্ম সম্প্রাপ্তির মাধ্যমেই মানুষ পাবে অনন্ত সুখ৷ এই অনন্ত সুখকেই দর্শনে বলা হয় আনন্দআনন্দং ব্রহ্ম ইত্যাহুঃ৷ ব্রহ্ম আনন্দঘন সত্তা৷ এই কারণেই এই আদর্শের নামকরণ হআনন্দমার্গঅর্থাৎ আনন্দের পথ৷ তিনি তাঁর এই আদর্শকে দেশে বিদেশে সর্বত্র প্রচারের জন্যে এক সংস্থা গড়ে তোলার কথা ঘোষণা করলেন৷ এই সংস্থার নাম রাখা হআনন্দমার্গ প্রচারক সংঘ৷ তিনি এখন থেকে শিষ্যদের কাছে পরিচিত হলেন সংঘগুরু শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী রূপে৷

১৯৫৫ সালে আনন্দমার্গ প্রচারক সংঘ প্রতিষ্ঠার পর তিনি তাঁর সংঘের কাজে গতি আনার জন্যে নোতুন নোতুন তাত্ত্বিক (যাঁরা তাঁর দর্শনে অভিজ্ঞ) ও আচার্য (যাঁরা তাঁর সাধনাপদ্ধতি শেখাবার যোগ্য) তৈরীর জন্যে বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করলেন৷ জামালপুরে আশ্রম ভবনেরও প্রতিষ্ঠা হল৷ আশ্রম প্রতিষ্ঠার পর প্রথম কয়েক বছর তিনি তাঁর গৃহী ভক্তদের দিয়েই বিহার ও পশ্চিম বাংলার বিভিন্ন স্থানে তাঁর নবপ্রবর্ত্তিত আনন্দমার্গ দর্শন ও আদর্শের প্রচার করতে থাকেন৷ ১৯৬২ সালে তিনি সন্ন্যাসব্যবস্থা প্রবর্ত্তন করলেন৷ আনন্দমার্গের সন্ন্যাসীদের বলা হয় অবধূত৷ যেমন, অভেদানন্দ অবধূত, বিজয়ানন্দ অবধূত প্রভৃতি৷ অবধূতরা আদর্শের প্রতিষ্ঠার জন্যে সর্বসময়ের নিবেদিত কর্মী৷

১৯৬৩ সালে মার্গগুরুদেব সংঘের কার্যক্রমের মধ্যে সমাজসেবাকে বিশেষ প্রাধান্য দিলেন৷ তিনি সংঘের একটি নোতুন শাখা স্থাপন করলেন, নাম দিলেন, Education, Relief and Welfare Section, (শিক্ষা, ত্রাণ ও জনকল্যাণ বিভাগ) সংক্ষেপে ERAWS। এই শাখার পক্ষ থেকে স্কুল, কলেজ, দাতব্য চিকিৎসালয়, অনাথ আশ্রম, রিলিফ টিমপ্রভৃতি খোলার কর্মসূচী ঘোষণা করলেন৷ ইতোপূর্বে পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্গত পুরুলিয়া জেলার গড়জয়পুরের রাজা আনন্দমার্গের ধর্মীয় ও সেবামূলক কাজের জন্যে ৬০০ বিঘা জমি দান করেন৷ এর পরে ওই এলাকায় আরও অনেক সজ্জন ব্যষ্টি জমিদান করেন৷ এই জমির ওপর গড়ে উঠল আনন্দমার্গের কেন্দ্রীয় কার্যালয়৷ এই স্থানের নোতুন নামকরণ হআনন্দনগর৷ মার্গগুরুর নির্দেশে দেশের প্রায় সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া পাহাড়জঙ্গলে পরিপূর্ণ এই আনন্দনগর এলাকায় গড়ে উঠেছে আনন্দমার্গের প্রাইমারী স্কুল, হাইস্কুল, হায়ার সেকেণ্ডারী স্কুল, ডিগ্রি কলেজ, হাসপাতাল (এলোপ্যাথি, হোমিও প্যাথি, আয়ুর্বেদিক, নেচারোপ্যাথিক, আকুপাংচার প্রভৃতি শাখাসহ), ভেটেরেনারী কলেজ, পশু চিকিৎসালয়, আনন্দমার্গ ইনষ্টিটিউট অব্ টেক্নোলজি প্রভৃতি বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান৷ পুরুলিয়ার এই টাঁড় জমিতে কিভাবে অর্থকরী ফসল ফলানো যায় তার জন্যে মার্গগুরুর নির্দেশে গড়ে তোলা হয় কৃষি গবেষণা কেন্দ্র৷ এর উদ্যোগে এখানে গড়ে তোলা হল চা বাগান, চন্দন বাগান, রাবার বাগান, আঙ্গুরের ক্ষেত, পানের বোরজ প্রভৃতিও৷ এগুলি অনুন্নত রাঢ় বাংলার দরিদ্র মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নের নোতুন পথ দেখালো৷

কেবল আনন্দনগরে নয়, আনন্দমার্গের সমাজসেবায় নিবেদিত প্রাণ শত শত সর্বত্যাগী কর্মী, তাত্ত্বিক, আচার্য, অবধূত ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ও বহির্ভারতের দেশে দেশে আনন্দমার্গের এই আধ্যাত্মিক ও সেবামূলক আদর্শের প্রচার করে যেতে লাগলেন৷ তাঁরা ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে জেলায় জেলায়ব্লকে ব্লকে আনন্দমার্গের স্কুল, অনাথ আশ্রম, দাতব্য চিকিৎসালয় প্রভৃতি গড়ে তুললেন৷ তাঁরা আনন্দমার্গ রিলিফ টিম গড়ে দেশের সর্বত্র বন্যা, খরা প্রভৃতি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময় দুর্গতদের সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়লেন৷ বহির্ভারতে বিভিন্ন দেশেও আনন্দমার্গের শাখাপ্রশাখার বিস্তার ঘটতে লাগল৷ আনন্দমার্গ ইউনিভার্সাল রিলিফ টিম বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভূমিকম্প, আগ্ণেয়গিরির অগ্ণুৎপাত, বন্যা, খরা প্রভৃতি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময় নিরলসভাবে ত্রাণকার্য চালিয়ে যাওয়ার সুবাদে রাষ্ট্রসংঘ কর্তৃক আন্তর্জাতিক সেবা সংস্থা হিসেবে স্বীকৃতি পেল৷

আজ সমাজের অধিকাংশ মানুষের সামাজিক অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নেই৷ কোটি কোটি  মানুষ দারিদ্র্য ও বেকারসমস্যায় জর্জরিত৷ ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে ধর্মের কথা শুণিয়ে লাভ নেই৷ আর সাময়িক ত্রাণব্যবস্থার মাধ্যমে সমস্যার স্থায়ী সমাধান হয় না৷ দরকার মানুষের অর্থনৈতিক, রাষ্ট্রনৈতিক সমস্যার স্থায়ী সমাধানের পথ৷ তাই মার্গগুরু তাঁর আনন্দমার্গ দর্শনের সঙ্গে সামাজিক অর্থনৈতিক দর্শনকেও সংযুক্ত করে দিলেন৷ তিনি সমাজের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাষ্ট্রনৈতিক তথা সার্বিক বিকাশের জন্যে এক নোতুন তত্ত্ব দিলেন৷ তার নামProgressive Utilisation Theory (প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব) সংক্ষেপে PROUT। ধনতন্ত্র ও মার্ক্সবাদের ত্রুটিবিচ্যুতি দূর করে এক আদর্শ সর্বাত্মক শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে প্রাউট

ধনতন্ত্র (ব্যষ্টিস্বাতন্ত্র্যবাদ) মানুষের ব্যষ্টিস্বাধীনতার (iIndividual liberty) ওপর মাত্রাধিক গুরুত্ব দিয়ে সমষ্টিস্বার্থকে ক্ষতিগ্রস্ত করে৷ আর মার্ক্সবাদ সমষ্টিস্বার্থের দোহাই দিয়ে ব্যষ্টিস্বাধীনতাকে অস্বীকার করে৷ ফলে এদের কোনটাই সমাজের যথার্থ কল্যাণ করতে পারছে না৷ কারণ অনেক ব্যষ্টিকে নিয়েই সমষ্টি৷ তাই ব্যষ্টি জীবনের সুষম বিকাশ না ঘটাতে পারলে সমাজেরও উন্নতি হতে পারে না৷ আর আত্মবিকাশের স্বাধীনতা ছাড়া ব্যষ্টির যথার্থ বিকাশও সম্ভব নয়৷ প্রাউটব্যষ্টিস্বাধীনতা ও সমষ্টি স্বার্থের মধ্যে সুষম সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে আদর্শ শোষণমুক্ত সর্বাঙ্গসুন্দর সমাজ রচনার পথ দেখাচ্ছে৷

ইতিহাসে আমরা দেখেছি, যাঁরাই সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে শোষণ, অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন ও এজন্যে নোতুন আদর্শ দিয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে শোষকশ্রেণীর পক্ষ থেকে নানান ষড়যন্ত্র হয়েছে৷

শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি৷ ১৯৭১ সালে শোষক গোষ্ঠীর নজির বিহীন ষড়যন্ত্রে শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা এনে তাঁকে পটনাতে কারারুদ্ধ করা হল ও ১৯৭৩ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারী জেলের মধ্যে তাঁকে হত্যা করার জন্যে তাঁর ওপর তীব্র বিষ প্রয়োগ করা হল৷ এই তীব্র বিষ যোগীশ্বর শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজীকে হত্যা করতে পারেনি৷ কিন্তু এই বিষের প্রতিক্রিয়া তাঁর সারা শরীরে ফুটে উঠেছিল৷ শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী এই বিষপ্রয়োগের বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবীতে জেলের ভেতরে ৫বছর ৪মাস ২দিন ঐতিহাসিক অনশন চালিয়ে গেলেন৷

ইতোমধ্যে ১৯৭৫ সালে উক্ত ষড়যন্ত্রের অঙ্গ হিসেবে দেশে জরুরী অবস্থা জারী করে আনন্দমার্গ প্রচারক সংঘকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়৷ পরে জরুরী অবস্থা উঠে গেলে ওই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়৷ ১৯৭৮ সালে মহামান্য উচ্চ আদালতে শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী সম্পূর্ণ নির্দোষ প্রমাণিত হন ও তিনি সসম্মানে মুক্তি পান৷

আনন্দমার্গের প্রচার দেশে ও বিদেশে দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে৷ দেশে দেশে আনন্দমার্গের প্রচারক প্রেরণ করা হয়৷ ফলে বিশ্বের ১৮২ টি দেশে শাখাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে৷

১৯৮২ সালে শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী নব্যমানবতাবাদ দর্শন দেন৷ তিনি বলেন, মানবতাবাদই সবচেয়ে বড় কথা নয়৷ মানবতাবাদে কেবল মানুষের কথাই ভাবা হয়৷ কিন্তু এই বিশ্বে মানুষ ছাড়াও অন্যান্য প্রাণী রয়েছে, উদ্ভিদ রয়েছে৷ তাদের স্বার্থের কথা ভাবা হয় না৷ মানুষের স্বার্থে তাদের ধ্বংস করা হয়৷ তাই এও ত্রুটিপূর্ণ৷ শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী বললেন, মানবতার যে মাধুর্যপ্রেমপ্রীতি, সেবাভাবনাএকে সমগ্র বিশ্বেবিশ্বের সমস্ত প্রাণী ও উদ্ভিদের মধ্যেও ছড়িয়ে দিতে হবে৷ এই যে বিশ্বের সমস্ত মানুষ, পশুপক্ষী, তরুলতা সবাইকে ভালভাসাসবার কল্যাণের জন্যে সচেষ্ট হওয়াএই হল নব্যমানবতাবাদ (Neo-humanism)৷ এর ভিত্তি হবে আধ্যাত্মিকতা৷ অখণ্ড আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি ছাড়া মানবতাবাদ মেকী মানবতাবাদে রূপান্তরিত হবে৷ মানবতাবাদের প্রেরণার উৎস শুষ্ক্ হয়ে যাবে৷ শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী বললেন, সমাজের শিক্ষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতিএই সবকিছুর ভিত্তি হওয়া উচিত নব্যমানবতাবাদ৷ তবেই মানবসবাজের যথার্থ কল্যাণ হবে৷

সঙ্গীতের ক্ষেত্রেও শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী (শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার) এক নোতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেন৷ অভিনব ভাব, ভাষা, সুর ও ছন্দের সমন্বয়ে তিনি মাত্র ৮ বছরে (১৯৮২ সালের ১৪ই সেপ্ঢেম্বর থেকে ১৯৯০ সালের ২১শে আক্টোবর পর্যন্ত) পাঁচ সহস্রাধিক (৫০১৮) সঙ্গীত রচনা ও তাতে নিজেই সুরারোপণ করেন৷ এই সঙ্গীতগুলি প্রভাত সঙ্গীত’  নামে পরিচিত৷ প্রভাত সঙ্গীতনামকরণের পেছনে বিশেষ তাৎপর্য হল, আজকে শিল্প, সংস্কৃতি তথা সঙ্গীতের ক্ষেত্রে যে অমানিশার অন্ধকার ঘনীভূত, সেই অন্ধকারের অবসান ঘটিয়ে প্রভাত সঙ্গীতনোতুন প্রভাতের সূচনা করেছে৷ বিদ্বত্ সমাজে ও সঙ্গীত মহলে প্রভাত সঙ্গীত আজ বহুল প্রশংসিত৷ আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন শিক্ষাবিদ্, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ও বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতপূর্ব উপাচার্য ও তিরুপতি সংস্কৃত বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্যঅধ্যাপক রমারঞ্জন মুখোপাধ্যায় এই প্রভাত সঙ্গীত সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, ‘‘প্রভাতসঙ্গীতকে আমরা অতিমানসের সঙ্গীত বলে চিন্হিত করতে চাই৷ শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী এইভাবেই পরিপূর্ণ সঙ্গীত উপহার দিয়েছেন৷ বর্তমান অবক্ষয়ের যুগে প্রভাত সঙ্গীত নোতুন যুগের সূচনা করে দিতে পারে যদি আমরা তা অনুধ্যান করি, যদি আমরা তা অনুশীলন করি৷’’ এইভাবে ধর্ম, শিক্ষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি প্রভৃতি সমাজের সর্বক্ষেত্রে অবহেলিত মানবতার নবজাগরণের নোতুন দিশা দিয়ে অবশেষে ১৯৯০ সালের ২১শে অক্টোবর শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী তাঁর কলকাতার বাসভবনে স্থূল দেহ পরিত্যাগ করেন৷ পেছনে রেখে যান বিশ্বব্যাপী সংঘটন, অজস্র সেবামূলক প্রতিষ্ঠান ও তাঁর মহান আদর্শের বাস্তবায়নের জন্যে নিবেদিত প্রাণ হাজার হাজার সর্বত্যাগী কর্মী, আচার্য, অবধূতবৃন্দ ও বিশ্বের ১৮২ টি দেশে তাঁর অগণিত অনুগামী৷

এছাড়াও তিনি রেখে গেছেন তাঁর বিপুল রচনাসম্ভার৷ তিনি একাধারে ধর্মগুরু ও সমাজগুরু হিসেবে সংস্কৃত, ইংরেজী, বাংলা ও হিন্দী ভাষায় দুই শতাধিক গ্রন্থ রচনা করে গেছেন৷ ধর্মশাস্ত্র, দর্শনশাস্ত্র, স্মৃতিশাস্ত্র, নীতিতত্ত্ব, সামাজিক–অর্থনৈতিক তত্ত্ব (প্রাউট), নব্যমানবতাবাদ, কৃষি, পরিবেশ, নারী অধিকার, ইতিহাস, স্বাস্থ্যবিজ্ঞান, ভাষাবিজ্ঞান, শব্দকোষ, সঙ্গীত, গল্প, শিশুসাহিত্য প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ে তিনি গ্রন্থ রচনা করেছেন৷

নিম্নে তাঁর কিছু কিছু গ্রন্থের নাম উল্লেখ করা হল ঃ

১) ধর্ম, দর্শন, নীতিশাস্ত্র বিষয়ক : জীবনবেদ, আনন্দসূত্রম্, Idea and ideology (ভাব ও ভাবাদর্শ), নমঃ শিবায় শান্তায়, নমামি কৃষ্ণ সুন্দরম, কৃষ্ণতত্ত্ব ও গীতাসার, ভক্তিরস ও কীর্ত্তন মহিমা, সুভাষিত সংগ্রহ (২৪ খণ্ড), আনন্দবচনামৃতম্ (৩৪ খণ্ড), যোগসাধনা, যোগমনস্তত্ত্ব, তন্ত্রই সাধনা ও সাধনাই তন্ত্র, আনন্দমার্গ প্রভৃতি৷

২) স্বাস্থ্য বিজ্ঞান বিষয়ক : যৌগিক চিকিৎসা ও দ্রবগুণ, দ্রব্যগুণে রোগারোগ্য৷

৩) ইতিহাস : বাংলা ও বাঙালী, সভ্যতার আদি বিন্দুরাঢ়, বাংলার মণিপ্রদীপ বরেন্দ্রভূমি, মহাভারতের কথা, পথ চলতে ইতিকথা (৬খণ্ড)৷

৪) সমাজচিন্তা, নব্যমানবতাবাদ, বিজ্ঞান : কণিকায় প্রাউট (২১ খণ্ড), প্রাউটের রূপরেখা, মানুষের সমাজ (২খণ্ড), আজকের সমস্যা, দেশপ্রেমিকের প্রতি, বুদ্ধির মুক্তিনব্যমানবতাবাদ, নব্যমানবতাবাদ ভিত্তিক শিক্ষা প্রভৃতি৷

৫) কৃষি ও পরিবেশ : কৃষিকথা, আমাদের প্রতিবেশী পশুপক্ষী৷

৬) নারীর অধিকার : নারীর মর্যাদা৷

৭) ভাষাবিজ্ঞান, ব্যাকরণ বিজ্ঞান, শব্দকোষ : বর্ণবিজ্ঞান, বর্ণবিচিত্রা (৮ খণ্ড), শব্দ চয়নিকা (২৬ খণ্ড)৷ প্রভাতরঞ্জনের ব্যাকরণ বিজ্ঞান (১৩ খণ্ড), প্রযোজনের পরিভাষা প্রভৃতি৷

৮) স৷ত : প্রভাত সঙ্গীত (১০ খণ্ড), নির্বাচিত প্রভাত সঙ্গীত (স্বরলিপি সহ,৫ খণ্ড)৷

৯) গল্প, শিশুসাহিত্য : 

প্রভাতরঞ্জনের গল্প সঞ্চয়ন (১৪ খণ্ড), প্রভাত সাহিত্যে আক্লমন্দ্, নীল সায়রের স্বর্ণকমল, নীল সায়রের অতলতলে৷ হট্টমালার দেশে, হট্টমালার আরও গল্প, তাড়া বাঁধা ছড়া, বর্ণপরিচয় (১ম, ২য় খণ্ড)৷