ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে শ্রাবণী পূর্ণিমার গুরুত্ব

লেখক
বিশেষ প্রতিনিধি

মানব ইতিহাসে শ্রাবণী পূর্ণিমার একটা বিশেষ তাৎপর্য আছে, এই তাৎপর্যকে অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করতে পারলে সমস্ত মানব সমাজের কল্যাণ৷

আজ সমগ্র সমাজেরই চরম নৈতিক অবক্ষয় দেখা দিয়েছে৷ মানুষ পশুর পর্যায়ে নেমে যাচ্ছে৷ যার জন্যে নিত্য ঘটছে নারী ধর্ষণ ও খুনের মত জঘন্য ঘটনা৷ চরম নোংরামী, পাপাচার, ব্যভিচার৷ দুর্নীতিতে মানব সমাজ আজ আকন্ঠ নিমজ্জিত৷ এ সবের প্রধান কারণ, মানুষ তার জীবনের আদর্শকে, জীবনের প্রকৃত লক্ষ্যকে ভুলে গেছে৷ ফলে লাগামহীন ভোগবাদ মানুষকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে৷ বিবর্তন ধারায় পশুজগৎ পেরিয়ে মানুষের আবির্ভাব৷ কিন্তু মানুষ তার মনুষ্যত্বকে ভুলে মানসিকতার দিক থেকে পশুর পর্যায়ে নেমে গেছে বললেও যথেষ্ট নয়, বরং পশুরও অধম হয়ে গেছে৷ জীবনের লক্ষ্য সম্পর্কে চিন্তা করার শক্তি পশুর নেই, মানুষের সে শক্তি আছে৷ কিন্তু মানুষের সেই উন্নত চিন্তাশক্তি থাকা সত্ত্বেও সে যখন পশুর মত আচরণ করছে, তখন তাকে পশ্বধমই বলতে হবে৷ হতে পারে আজ মানুষ বৌদ্ধিক ক্ষেত্রে অনেক উন্নত, কিন্তু সে ভেবেই দেখছে না (অধিকাংশ ক্ষেত্রে) মানবজীবনের আসল বৈশিষ্ট্যটা কোথায়?

আজ থেকে সাত হাজার বছর পূর্বে ভারতের বুকে এক বিরাট পুরুষের আবির্ভাব হয়েছিল৷ তিনি মানুষকে শিখিয়েছিলেন, আহার–নিদ্রা–ভয়–সং করা মানুষ ও পশু উভয়ের সাধারণ বৈশিষ্ট্য কিন্তু মানুষের অধিকতর  বিশেষত্ব হ’ল তার ‘ধর্ম’৷ তিনি বুঝিয়েছিলেন, ‘ধর্ম’ মানেই তার সত্তাগত বৈশিষ্ট্য৷ আগুনের সত্তাগত বৈশিষ্ট্য তার দাহিকা শক্তি, চিনির সত্তাগত বৈশিষ্ট্য মিষ্টত্ব, এমনি ভাবে প্রতিটি পদার্থের আপন আপন ‘ধর্ম’ (বিজ্ঞানের ভাষায় ইংরেজীতে যাকে প্রপার্টি বলা হয়েছে) তথা সত্তাগত বৈশিষ্ট্য রয়েছে৷ তেমনি মানুষের সত্তাগত বৈশিষ্ট্য হ’ল, মানুষের অন্তরের অনন্ত ক্ষুধার পরিতৃিপ্তি ঘটানোর জন্যে অনন্ত ‘ব্রহ্মে’র অর্থাৎ ঈশ্বরের অনুসন্ধান করা৷ প্রকৃতপক্ষে তখনই মানুষ পারে অন্তরের অনন্ত সুখের অর্থাৎ ‘আনন্দে’র সন্ধান৷ শাস্ত্রে তাই বলা হয়েছে ‘আনন্দম্ ব্রহ্ম’৷ বলা বাহুল্য ‘ব্রহ্ম’, ঈশ্বর, গড, আল্লা–একই, বিভিন্ন ভাষায় একই সত্তার উদ্দেশ্যে এই শব্দগুলি ব্যবহৃত হয়েছে৷

মানুষের জীবনের বিশেষত্ব এই ধর্ম৷ (আহার–নিদ্রা–ভয়–মৈ/ সমানমেতদ্ পশুভিঃ নারাণাম্৷/ ধর্ম হি তেষাং অধিক বিশেষ/ ধর্মেণ হীনা পশুভিঃ সমানা৷৷) আজ থেকে সাত হাজার বৎসর পূর্বে ‘সদাশিব’ নামে এক বিরাট পুরুষ এই মহাবাণী ঘোষণা করেছিলেন৷ শুধু তাই নয়, কেমন করে মানুষ এহ ধর্মানুশীলন করবে তার যুক্তি–বিজ্ঞান সম্মত পথেরও নির্দেশনা তিনি দিয়েছেন৷ তা–ই যোগ–তন্ত্র নামে পরিচিত৷ আর এই শ্রাবণী পূর্ণিমা তিথিতেই তিনি তাঁর এই ধর্ম প্রচার শুরু করেছিলেন৷ এই কারণেই শ্রাবণী পূর্ণিমাকে শিব ভক্তরা এক বিশেষ পুণ্য তিথি হিসেবে গণ্য করেন৷

এখানে উল্লেখ্য শিবের ধর্ম প্রচারের পর সাত হাজার বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে৷ স্বাভাবিক ভাবে, মানুষ শিবকে অন্যান্য কাল্পনিক তেত্রিশ কোটি দেবতার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছেন ও স্বাভাবিক ভাবে শিবকে নিয়েও নানান্ কাল্পনিক গল্প কথা তৈরী হয়েছে৷ এই সমস্ত গল্পকথার গহণ অরণ্য ভেদ করে গভীর বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমে সেই সদাশিবের প্রকৃত শিক্ষা কী– তা সত্যের আলোকে আজ উদ্ভাসিত করে তুলেছেন আনন্দমার্গের প্রতিষ্ঠাতা শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী তাঁর ‘নমঃ শিবায় শান্তায়’ গ্রন্থে৷

ধর্মগুরু শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী গুরু হিসেবে আত্মপ্রকাশ এই শ্রাবণী পূর্ণিমা তিথিতে৷ সেটা ছিল ১৯৩৯ সাল৷ শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তির তখনও তিনি ‘শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তি’ নামে পরিচিত হন নি৷ তাঁর লৌকিক নাম প্রভাতরঞ্জন রূপেই পরিচিত৷ তখন তিনি বিদ্যাসাগর কলেজে পড়তেন৷ জামালপুরে ছেলেবেলাতেই তিনি দুর্গম কালীপাহাড়ে ঘোরাফেরা করতেন৷ কলকাতায় তখন প্রতিদিন গঙ্গার ধারে (তখন এই এলাকা নির্জন ও নানান্ গাছালিতে পূর্ণ ছিল) বেড়াতেন৷ প্রতিদিনকার মত শ্রাবণী পূর্ণিমার দিনেও সন্ধ্যেবেলা বেড়ানোর সময় গঙ্গাতীরে কাশীমিত্র ঘাটে এক ভয়ঙ্কর ডাকাতের সঙ্গে পরিচিত হন৷ শ্রী প্রভাতরঞ্জন এতদিন যে মহাসম্পদ লুকিয়ে নিয়ে বেড়াতেন, এদিন তিনি তাঁর সেই রত্নভান্ডারের ঝাঁপি খুলে দিলেন কালীডাকাতের কাছে৷ কালীডাকাতের জীবনের আমূল পরিবর্তন হ’ল৷ তিনি চিনতে পারলেন বালকবেশে ইনিই তাঁর আধ্যাত্মিক গুরু৷ গুরুর কাছে আধ্যাত্মিক সাধনা শিখে কালীডাকাত পরিণত হ’ল মহান অমৃতকুম্ভ সন্ধানী সাধকে৷ পরবর্তী কালে তিনি হলেন সন্ন্যাসী কালিকানন্দ৷ শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী সেদিন এক উন্মার্গগামী মানুষের জীবনে আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে ‘আনন্দমার্গে’র বীজবপন করলেন৷ সেই বীজ আজ মহীরুহ হয়ে সারা বিশ্বে তার শাখা প্রশাখা বিস্তার করে’ বিশ্বধর্মে পরিণত হয়েছে৷ শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী তাঁর দর্শন তথা আদর্শের নামও ‘আনন্দমার্গ’ রেখেছেন এই তিথিতেই৷ এদিক থেকে শ্রাবণী পূর্ণিমা তিথি এক বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ৷

এ ছাড়া, বাংলার ইতিহাসে এই তিথিটির আরও এক গভীর তাৎপর্য রয়েছে৷ ১৯০৫ সালে ব্রিটিশ শাসক লর্ড কার্জন বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত করে বাংলাকে হতবল করার চেষ্টা করেছিলেন৷ তার বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন ঋষি অরবিন্দ, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ, প্রভৃতি বাংলার মনীষীগণ৷ সেই বঙ্গ ভঙ্গের বিরুদ্ধে সারা বাংলা জুড়ে আন্দোলন শুরু হ’ল৷ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ তখন সমস্ত বাঙালী জাতির মধ্যে ঐক্যের প্রতীক রূপে হিন্দু–মুসলমান নির্বিশেষে সবার হাতে ‘রাখী’ পরিয়ে ‘রাখী বন্ধন’ উৎসবের সূচনা করেছিলেন এই শ্রাবণী পূর্ণিমাতে৷ বাঙালী ঐক্যের গানও রচনা করেছিলেন ‘‘বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, হে ভগবান.....’’