আনন্দমার্গী ও শ্রাবণী পূর্ণিমা

লেখক
জ্যোতিবিকাশ সিন্হা

আনন্দমার্গের সাধনা,

আনন্দমার্গীদের জীবন ও শ্রাবণী পূর্ণিমা---একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত৷ বস্তুতঃ শ্রাবণী পূর্ণিমার পূণ্যলগ্ণেই আনন্দমার্গ সাধনার সুত্রপাত৷ ১৯৩৯ সালের শ্রাবণী পূর্ণিমার পবিত্র সন্ধ্যায় সদ্গুরুর কৃপায় পৃথিবী নামক গ্রহের মানব মনে যে বীজমন্ত্র প্রথম নিষিক্ত হয়েছিল, আজ তা বিশ্বের ১৮২ টি দেশে লক্ষ লক্ষ আনন্দমার্গীর অন্তরের গভীরে পল্লবিত, পুষ্পিত হয়ে পরম মুক্তির মহা মন্ত্রে উত্তরিত--- জড়ত্বের অন্ধ তমসার বাঁধন ছিঁড়ে ভূমাচৈতন্যের অনন্ত আলোকঝর্ণাধারার পথের দিশারী৷

সন ১৯৩৯, তিথি শ্রাবণী পূর্ণিমা, সময় সায়ংকাল৷ এক পশলা শ্রাবণের বারিধারায় সিক্ত প্রকৃতিতে স্নিগ্দ শীতলতার আমেজ৷ মেঘমুক্ত আকাশের বাঁধভাঙা জ্যোৎস্নার প্লাবনে ভাগীরথীর তীরবর্তী কাশীমিত্র ঘাটে এক মোহময়ী পরিবেশ৷ আর সেই নির্জন নদীতীরে উপবিষ্ট এক জ্যোতিষ্মান পুরুষশ্রেষ্ঠ, অষ্টাদশবর্ষীয় সৌম্য , শান্ত যুবক ঊধর্র্বকাশে অবলোকনরত--- যেন কোনো অনাগত ভবিষ্যতের মহাপরিকল্পনায় নিমগ্ণ, নিবিষ্ট৷ এমন সময় একজন কুখ্যাত দস্যু, কালী ডাকাত (পিতৃদত্ত নাম কালীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়) শানিত অস্ত্র হাতে আগুয়ান--- উদ্দেশ্য উপবিষ্ট যুবকের সর্বস্ব হরণ৷ হঠাৎ জলদ গম্ভীর স্বরের বজ্র নির্ঘোষ, ‘‘কালীচরণ, এগিয়ে এসো’’--- এই শব্দ যেন মহাকাশ থেকে উত্থিত হয়ে দুরন্ত শক্তিতে কালীচরণের কর্ণপটহে আঘাত হানতে থাকল৷ কালী ডাকাত ভাবতে লাগল, কে এই যুবক? কি করে সে তার নাম জানল? ---এইসব প্রশ্ণ তাকে বিভ্রান্ত করতে থাকে৷ এমনই পরিবেশে পুনরায় সেই অমোঘ আহ্বান,--- ‘‘কালীচরণ , সামনে এসো’’৷ এই নির্দেশ বা আদেশকে উপেক্ষা করার সামর্থ্য কালী ডাকাতের ছিল না৷ সে বুঝতেও পারল না কখন তার হাতের অস্ত্র খসে পড়েছে৷ মন্ত্র চালিতের মতো গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে আসে সেই জ্যোতির্ময় পুরুষের সামনে৷ আবার ধেয়ে এলো প্রশ্ণ ‘‘এই ঘৃণ্য পেশা বেছে নিয়েছো কেন? এই জঘন্য কাজ করতে তোমার ভাল লাগে?’’ ‘‘না-না’’--- বলতে বলতে দুচোখের অশ্রুধারায় তার বাহ্যিক কাঠিন্যের খোলস খসে পড়ল৷ কান্না ভেজা স্বরে সে ব্যক্ত করল তার অতীত জীবনের বৃত্তান্ত, ব্রাহ্মণ সন্তান হয়েও পরিস্থিতির চাপেই সে আজ কুখ্যাত কালী ডাকাত৷ সৌম্যকান্তি যুবা সুকোমল স্বরে কালীচরণকে আশ্বস্ত করে বললেন ,‘‘যদি তোমার সব ভার, সমস্ত দায় আমি নিয়ে নিই, তবে এ কুৎসিত জীবন থেকে নিসৃকতি পেতে চাও? ’’ এবার কালীচরণ আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না--- অশ্রুবন্যায় ভাসতে ভাসতে সে আর্তনাদ করে সম্মুখবর্তী করুণাসিন্ধুর চরণে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে সমর্পণ করল৷ সস্নেহ কন্ঠে নির্দেশ ভেসে এল, ‘‘যাও, গঙ্গায় ডুব দিয়ে এসো৷ তোমাকে নোতুন জীবনের সন্ধান দেব৷’’ নিদের্শমতো গঙ্গায় ডুব দেওয়ার পর কালীচরণের মনে হল তার সমস্ত শরীর-মন ভারমুক্ত হয়ে গেছে, এতদিনের সব গ্লানি ধুয়ে মুছে আজ সে শুদ্ধ, পবিত্র৷ অচেনা হিল্লোলে তার মনোজগৎ আন্দোলিত হয়ে চলেছে৷ ধীর পায়ে এগিয়ে এসে সেই দিব্য পুরুষের নির্দেশ মতো তাঁরই সামনে পদ্মাসনে উপবেশন করল ও দীক্ষাগ্রহণ করে নবজীবন প্রাপ্ত হল৷ তৎকালীন নিয়মানুসারে দীক্ষান্তে গুরুদক্ষিণা দেওয়ার চল ছিল৷ কিন্তু কালীচরণের কাছে কোনো অর্থ ছিল না৷ তাই গুরুই তাঁর পকেট থেকে একটি ‘সিকি’ মুদ্রা বার করে কালীচরণের হাতে দিয়ে গুরুদক্ষিণা দিতে বললেন৷ শিষ্য গুরুর নির্দেশ পালন করার পর জানালেন, এ তো গঙ্গা জলে গঙ্গা পূজা হল! গুরুও সস্নেহে বললেন, ‘‘তোমার সব ভার তো আমিই নিয়েছি, সেজন্যেই গুরুদক্ষিণার অর্থ জোগান দেওয়ার দায়িত্বও আমার৷’’ মধুঝরা কন্ঠে তিনি আরও জানালেন, ‘‘এই কারণেই আজ থেকে আমি দীক্ষান্তে গুরুদক্ষিণার প্রথা রদ করলুম৷’’

এই দিব্যকান্তি পরম করুণাময় জ্যোতির্ময় পুরুষের নাম শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার৷ ওই সময় তিনি কলকাতার শোভাবাজারে মাতুলালয়ে অবস্থান করে বিদ্যাসাগর কলেজে পাঠরত ছিলেন৷ প্রতিদিনের অভ্যাস মতো সন্ধ্যাবেলায় তিনি গঙ্গার তীরে পদচারণা করতে যেতেন ও বেশ কিছুটা সময় সেখানে কাটিয়ে মাতুলালয়ে ফিরে আসতেন৷ এভাবেই ঘটে গেল ১৯৩৯ সালে শ্রাবণীপূর্ণিমার শুভ সন্ধ্যায় অষ্টাদশ বর্ষীয় যুবক শ্রী প্রভাতরঞ্জনের প্রথম দীক্ষাদানের যুগান্তকারী ঘটনা৷ কালক্রমে তিনি সমগ্র পৃথিবীতে আনন্দমার্গের প্রবর্তক আধ্যাত্মিক গুরু শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী নামে পরিচিত হয়েছিলেন৷ শ্রাবণী পূর্ণিমাতেই বর্তমান বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম সদ্গুরু শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজীর গুরু হিসেবে প্রথম আত্মপ্রকাশ---যাঁর পর্থনির্দেশনায় আজ লক্ষ লক্ষ আনন্দমার্গের সাধক যোগ সাধনার মাধ্যমে মানবাধারে দেবত্বের অনুশীলন ও ব্রহ্মভাবের আস্বাদন করে চলেছেন৷ সেদিনের দুর্ধর্ষ , নিষ্ঠুর, হিংস্র কুখ্যাত দস্যু কালীচরণ বন্দোপাধ্যায় ওরফে কালী ডাকাত যোগ সাধনায় দীক্ষিত হওয়ার পর কঠোর সাধনার ফলশ্রুতিতে পরবর্তীকালে ‘‘কালিকানন্দ অবধূত’’ নামে এক মহাত্মা সাধুপুরুষে পরিণত হয়েছিলেন৷ প্রকৃত পক্ষে তিনিই ছিলেন সমস্ত আনন্দমার্গ-সাধেেকর অগ্রজ প্রতিম৷

মহানঋষি শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার ওরফে শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী জগৎ কল্যাণে ১৯৫৫ সালে ‘‘আনন্দমার্গ প্রচারক সংঘের’’ প্রতিষ্ঠা করেন ও প্রকৃত শোষণহীন সমাজ রচনার উদ্দেশ্যে ১৯৫৯সালে ‘‘প্রাউট, বা প্রগতিশীল উপযোগ তত্ব’’ নামে নোতুন সামাজিক- অর্থনৈতিক দর্শন প্রবর্তন করেন যা আজ বিশ্বের ১৮২টি দেশে প্রসারিত হয়ে বর্তমান সমাজকে নোতুন আদর্শের নবালোকে উদ্ভাসিত করে মহত্তর জীবনের সন্ধান দিয়ে চলেছে৷ আধ্যাত্মিক গুরু হিসেবে শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী যেমন প্রতিটি আনন্দমার্গীর আধ্যাত্মিক উন্নতির প্রতি সর্বদা সতর্ক দৃষ্টি রেখেছেন--- ঠিক তেমনি তাদের ত্রিস্তরীয় (জাগতিক,মানসিক ও আধ্যাত্মিক) সর্বাত্মক প্রগতির জন্যে পথনির্দেশনাও দিয়ে গিয়েছেন৷ শুধু তাই নয়, মানুষের সর্র্বঙ্গীন উন্নতির জন্যে কখনও স্নেহশীল পিতারূপে অশেষ করুণা ধারায় অহৈতুকী কৃপা বর্ষণ করেন , সমস্ত বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করেছেন, সর্বদা পাশে থাকার নিশ্চিত আশ্বাস দিয়েছেন, আবার কখনো প্রয়োজনবোধে অত্যন্ত কঠোর প্রশিক্ষকের ভূমিকাও পালন করেন যাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য হল মানুষের সার্বিক মঙ্গল সাধন৷

‘‘নিগ্রহানুগ্রহে শক্তো গুরুরিত্যভিধীয়তে৷’’

গুরুশব্দের অর্থ --- গু= অন্ধকার, রু= যিনি দূর করেন৷ অর্থাৎ যিনি শিষ্যের মনের সমস্ত অন্ধকার দূর করে পরম জ্ঞানের দীপশিখা প্রজ্জ্বলিত করে তোলেন, তিনিই গুরুপদবাচ্য৷ মানুষকে পরমজ্ঞান তথা ব্রহ্মজ্ঞান একমাত্র পরমব্রহ্মের পক্ষেই দান করা সম্ভব৷ তাই আনন্দসূত্রমে বলা হয়েছে---‘‘ব্রহ্মৈব গুরুরেকঃ না পর৷ ’’ সুতরাং পরমপুরুষ পরমব্রহ্মই একমাত্র গুরু --- আর পরমপুরুষ জীবকুলের মুক্তিপথের সন্ধান দিয়ে সামূহিক পরিত্রাণের জন্যে যখন ধূলার ধরণীতে আবির্ভূত হন তখনই তাঁকে আমরা সদ্গুরু নামে অভিহিত করি৷ মহাসম্ভূতি তারকব্রহ্ম শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজীর ভাষায় ---

‘‘যিনি সাধনবলে পরমপদ প্রাপ্ত হয়ে জন কল্যাণের সংকল্প নিয়ে পুনরায় স্বেচ্ছায় নির্দ্দিষ্ট সময়ের জন্যে প্রাকৃত গুণাধীন হন তথা মনুষ্যদেহ ধারণ করেন, তিনিই কেবল গুরু হতে পারেন৷ যতদিন তিনি দেহ ধারণ করে থাকেন, ততদিনই কেবল প্রাকৃত গুণাধীন থাকেন, দেহান্তে তিনি আবার পরম গুণাতীত সত্তায় লীন হয়ে যান৷ পরম গুণাধীন সত্তা বা ভগবানই মুক্ত আর তাই তিনিই গুরু অর্থাৎ গুরু আর ভগবানের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই৷’’

শ্রাবণী পূর্ণিমার পবিত্র তিথিতে প্রথম দীক্ষা দানের মাধ্যমেই সূচিত হয়েছিল সদ্গুরু শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজীর শুভাবির্ভাব যা মানবজাতির ইতিহাসে যুগ যুগ ধরে এক অবিস্মরণীয় মুহূর্ত হিসেবে চিহ্ণিত হয়ে থাকবে৷ আজ বিশ্বব্যাপী জনকল্যাণমুখী কর্মযজ্ঞে আনন্দমার্গ সংঘটনের জয়যাত্রা, লক্ষ লক্ষ আধ্যাত্মিক মুক্তি পিপাসু মানুষের সাধনপথে অগ্রসরণ, আগামীদিনের শোষণমুক্ত সমাজের আনন্দময় পরিবেশে মানুষের জীবন যাপনের অনাবিল আকুলতা ও সেই পথে সুনিশ্চিত দৃঢ় পদবিক্ষেপ--- এসবেরই শুভ সূচনা হয়েছে, ১৯৩৯ সালের শ্রাবণী পূর্ণিমার পবিত্র সন্ধ্যায়৷ তাই প্রতিটি আনন্দমার্গীর জীবনে শুভ শ্রাবণীপূর্ণিমার প্রভাব ও অবদান অপরিসীম ও অবিস্মরণীয়৷