অসংস্কৃতি ও সামাজিক ব্যাধি

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

সম্প্রতি গুজরাটের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হর্ষ সাংভির মন্তব্য করেছেন ধর্ষন বৃদ্ধির জন্যে মোবাইল দায়ী৷ সিংভির কথায়  মোবাইলে খুব সহজেই পর্ণ ভিডিও দেখা যায়৷ সে কারণেই দেশে ধর্ষণের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে৷ তিনি ধর্ষনকে সামাজিক   ব্যাধি বলে উল্লেখ করে পুলিশ প্রশাসনের  নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ মানতে নারাজ৷

সাংভির অভিযোগ একশ শতাংশ সত্য৷ অর্থাৎ ধর্ষণ খুন আরও নানা সামাজিক ব্যাধির কারণ মোবাইল অবশ্যই৷ তবে শুধু মোবাইল দায়ী নয়৷ চলচিত্র, সাহিত্য এমনকি ক্রিকেট মাঠেও চিয়ার্স গ্লার্লস সব কিছুই নানা সামাজিক ব্যাধির ভাইরাস৷ তবে পুলিশ প্রশাসনকে একেবারে ছাড় দেওয়া যায় না৷ অপরাধী তৈরীতে পুলিশের কোন ভূমিকা থাকে না৷ কিন্তু অপরাধ দমনে পুলিশের বড় ভূমিকা অবশ্যই থাকে৷ পুলিশ তার দায়িত্ব যথাযথ পালন করলে অপরাধ অনেকটাই কমতে পারে৷ কিন্তু রাজনৈতিক ও আরও নানা কারণে পুলিশ তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করে না বা করতে পারে না৷ পর্ণমার্কা সাহিত্য চলচিত্র যেমন অপরাধী-তৈরীতে  ইন্ধন যোগায় তেমনি পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা বা ঘটনাকে আড়াল করার চেষ্টা অপরাধীকে বেপরোয়া ও দুঃসাহসিক করে তোলে৷ সমাজ থেকে এই ব্যাধি নির্মূল করতে হলে যেমন পুলিশ প্রশাসনকে অপরাধী দমনে কঠোর হতে হবে তেমনি অপরাধী তৈরীর উৎসগুলি বন্ধ করতে হবে৷

সাংভির রোগ ঠিক ধরেছেন৷ তবে আদিম প্রবৃত্তিতে সুড়সুড়ি দিয়ে যুবসমাজ কে বিপথে ঠেলে দেবার চেষ্টা মুঠো ফোন বাজারে আসার অনেক আগে থেকে শুরু হয়েছে পর্ণমার্কা সাহিত্য চলচ্চিত্র ইত্যাদির মাধ্যমে৷ ফ্যাসিষ্ট পুঁজিপতি শোষকের শোষণের  অন্যতম হাতিয়ার  অসংস্কৃতির ধারক পর্ণমার্র্ক সাহিত্য চলচ্চিত্র নাটক ইত্যাদি  যার মাধ্যমে যুবসমাজ হীন চিন্তায় হীন কর্মে মাতিয়ে দিয়ে অবাধে শোষনের ষ্টীম রোলার চালিয়ে যাওয়া৷ খুন ধর্ষনের মত সামাজিক ব্যাধিকে সমাজ থেকে নির্মূল করতে হলে কবি সাহিত্যিক শিল্পীকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে হবে, অপরাধী দমনে পুলিশ প্রশাসনকে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে হবে, রাজনৈতিক দাদা গিরি বন্ধ করতে হবে৷

কবি সাহিত্যিক শিল্পীদের ভূমিকার কথাই এখানে আলোচ্য৷ কারণ সামাজিক ব্যাধির সঙ্গে অসংস্কৃতির নাড়ীর যোগ৷ এই যোগ ছিন্ন করতে না পারলে সামাজিক ব্যাধি নির্মূল করা সম্ভব নয়৷ শিল্প সাহিত্যের মাধ্যমেই অসংস্কৃতি সমাজে সংক্রমন ব্যাধির মত ছড়িয়ে পড়ে ও যুব সমাজকে  কু-পথে চালিত করে৷ একথা মানতে রাজী হবেন না শিল্প-সাহিত্য কলা জগতের কুশি-লবরা৷ শিল্পীর স্বাধীনতা তাঁদের একান্ত কাম্য৷

শিল্পীর স্বাধীনতা অবশ্যই থাকা উচিৎ৷ কিন্তু ফরাসী বিপ্লবে যদি হুগো, স্তল স্তয়দের ভূমিকা থাকে, ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে যদি ‘আনন্দ মঠ’ নীলদর্পন ‘পথের দাবী’ যদি যুব-মানসে দেশপ্রেমের উদ্দীপনা আনতে পারে, তবে  বিপরীত ধর্মী শিল্প সাহিত্য যুব সমাজকে বিপথে ঠেলে দিতে পারে৷ একটি গনের একটি শব্দ ‘বন্দেমাতরম’ যদি দেশপ্রেমের মন্ত্র হতে পারে, বিদেশী শাসকের আতঙ্কের কারণ হতে পারে৷ আবার কেউ যদি নীরাকে অন্য ধরণের কবিতা লেখে, তবে তা যুব সমাজকে অন্য পথে চালিত করবে এটাই বাস্তব৷ কিন্তু কবি সাহিত্যিক শিল্পীরা এটা মানতে চান না৷ তাঁদের কাছে শিল্পীর স্বাধীনতাই কাম্য৷ সাহিত্যের সঙ্গে সমাজের হিতের একটা সম্পর্ক আছে৷ সাহিত্য কথাটীর মধ্যেই হিত শব্দটা নিহিত আছে৷ তাই যে  সাহিত্যের মধ্যে হিতের ভাবনা থাকে না, যে সাহিত্য মানুষকে সার্বিক কল্যাণের ভাবনায় উদ্দীপ্ত করে না,  বিপরীতে মনের গহণে সুপ্ত হীন প্রবৃত্তিগুলোকে জাগিয়ে তোলে তা সে যত উন্নতমানের রচনাই হোক সাহিত্য পদবাচ্য নয়, তা সাহিত্য হতে পারে না৷ তাই সামাজিক ব্যাধি বৃদ্ধি পাওয়াতে চটুল রসের সাহিত্য শিল্প চলচিত্রের বড় ভূমিকা থাকে তা নিয়ে কবি সাহিত্যিক শিল্পীদের ভাবার সময় এসেছে যাতে সমাজের  সূচিতা রক্ষা করা যায়৷

তবে এই সব সামাজিক ব্যাধির আসল কারণ পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থা৷ পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থায় পুঁজিপতি শোষকের লক্ষ্যই হলো---কোন এক জনগোষ্ঠীকে শোষণের আগে অসংস্কৃতির স্রোত বহিয়ে সেই জনগোষ্ঠীর মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া যাতে তারা শোষণের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে৷ উন্নতমানের চলচ্চিত্র-নাটক দূর করে দিয়ে অতি নিম্নমানের চলচ্চিত্র নাটক ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে একটি জনগোষ্ঠীকে পঙ্গু করে দেওয়া৷

ভারতে আজ পুঁজিপতি শোষকরা অতি নিপুনভাবে এই কাজটি করে চলেছে৷ তাই শুধু মোবাইল নয়, শিল্প সাহিত্য নাটক গানের মধ্যে অশ্লীল অসংস্কৃতির প্রাদুর্ভাব৷ এই অবস্থায় শুধুই মোবাইলের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না৷ পুঁজিবাদী রাষ্ট্র কাঠামোয় আমূল পরিবর্তন আনতে হবে, বাস্তবমুখী বিকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক পরিকল্পনার রূপায়ন করে মানুষকে আর্থিক স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে দিতে হবে৷ তবেই সামাজিক সুচিতা ফিরিয়ে আনার কাজ সহজ হবে৷