অতীতের পৃষ্ঠা থেকে জন্মদ্বিশতবর্ষে - প্যারীচরণ সরকারের কিছু কথা৷

লেখক
মণিমেখলা মাইতি                                             

বিস্মৃত বাঙালিকে ক্ষমা করে দিন আপনি৷ আপনি তো মুক্ত মনের মানুষ৷ এ ক্লেদাক্ত সমাজে আপনাকে আজ কোন দরকার নেই৷ সত্যিই তো, আপনার অবদান কে কবেই বা মনে রাখলো! সেই ১৮৪৭ সালের কথা কেউ মনে রাখে! সাধারণ বাড়ির মেয়েরা তখন পড়াশুনা করে না৷ মেয়েরা পড়লে বিধবা হবে, স্ত্রীশিক্ষা হল ’’কালকেউটের বিষ’’৷ তাই ধামায় করে পিতা পাঁচ বছর বয়সে কন্যাদান করেন৷ মেয়ে অন্ধকার আলোয় রাঁধে, বাড়ে, সংসার বৃদ্ধি করে৷ তার কাছে বাইরের পৃথিবী অধরা৷ এমন অবস্থায় এগিয়ে এসেছিলেন পুণ্যশ্লোক প্যারীচরণ সরকার৷ বারাসাতে কালীকৃষ্ণ মিত্র, নবীনকৃষ্ণ মিত্রের সহযোগিতায় গড়ে তুললেন সাধারণ মেয়েদের জন্য প্রথম প্রকাশ্য বিদ্যালয়৷ দেশের মধ্যে প্রথম কি? সে ঐতিহাসিকেরা জানেন৷ এক যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটিয়ে ফেললেন প্যারীচরণ৷ সাধারণ বাড়ির মেয়েদের জন্য খুলে দিলেন পড়াশোনার দ্বার৷ এ তো খুবই সামান্য ঘটনা৷ তাই এ ঘটনা বাঙালির মনে রাখার দরকার নেই৷

বারাসাতে স্কুল করার জন্য প্যারীচরণ একঘরে হলেন, প্রতিদিন প্রাণনাশের হুমকি, ডাকাত দিয়ে তাঁকে মেরে ফেলার চেষ্টা৷ না, দমেননি এই যুগপুরুষ৷ মেয়েদের শিক্ষার জন্য সওয়াল করেই তাঁর লড়াই৷ বারাসাতে এই স্কুল দেখেই আকৃষ্ট হন বেথুন৷ কলকাতায় দু বছর পর গড়ে তুললেন বেথুন স্কুল৷ বাঙালি ধন্য ধন্য করল৷ আর ভুলে গেল স্ত্রীশিক্ষার প্রথম স্থপতিকে৷ সাধারণ বাঙালি মেয়েরা যে আজকে এত সফল, তাঁর নেপথ্যে কি এই মানুষটির কোন অবদান নেই? সত্যিই তো, কীই বা করেছেন তিনি!

মেয়েদের পড়াশোনা নিয়ে প্যারীচরণের চিন্তাভাবনা সুদূরপ্রসারী৷ ১৮৫২ তে মেয়েদের পড়াশুনার পক্ষে যুক্তি সাজিয়ে কলকাতায় বেথুন সোসাইটিতে পাঠ করেছিলেন দীর্ঘ প্রবন্ধ৷ তখন তিনি কলকাতায় কলুটোলা ব্রাঞ্চ স্কুলে (হেয়ার স্কুল) বদলি হয়ে এসেছেন৷ শুধু তাই নয় ১৮৬৮- তে চোরবাগানে নিজের বাড়িতে গড়ে তুললেন চোরবাগান বালিকা বিদ্যালয় (বর্তমানে প্যারীচরণ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়)৷ যা তখনকার মূল কলকাতার প্রথম বাঙালি প্রতিষ্ঠিত স্কুল৷ এখানেও তিনি একঘরে হলেন৷ প্রাণনাশের হুমকি৷ মেয়েদের পড়তে দেওয়া হবে না বলে আন্দোলন৷

সবকিছু উপেক্ষা করে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনলেন প্যারীচরণ সেই স্কুলে৷ বিবাহিত মেয়েদের জন্য স্কুলের দরজা খুলে দিলেন৷ অন্তঃপুর স্ত্রীশিক্ষার সূচনা করলেন কলকাতায়৷ মেয়েরা স্কুলে আসত অথবা বাড়িতে সিলেবাস নিয়ে গিয়ে পড়াশুনা করত৷ যেসব বিবাহিত মেয়েদের প্রকাশ্যে এসে পরীক্ষা দেওয়ার অধিকার ছিল না, শিক্ষয়িত্রী প্রশ্ণপত্র নিয়ে তাদের বাড়িতে পৌঁছে গিয়ে পরীক্ষা নিত৷ ভালো ফল করলে দারুণ সব উপহার৷ চোরবাগান বালিকা বিদ্যালয় থেকেই বেরোত ১৮৭৫-৭৬ সালে সাধারণ মেয়েদের জন্য প্রথম মেয়েদের পত্রিকা ’’বঙ্গমহিলা’’৷ এ সব অভিনব ব্যাপার প্যারীচরণ সরকারের মস্তিষ্কপ্রসূত৷ সেখানে নিজে কলম ধরেছিলেন৷ অথচ আজকের চোরবাগান প্যারীচরণ সরকারকে চেনে না৷ তাঁর প্রতিষ্ঠিত স্কুলটি আছে সেটাই জানে না৷ কেনই বা জানবে? কী করেছেন তিনি!

বাঙালি ভুলে গেছে রবীন্দ্রনাথের ’’জীবনস্মৃতি’’র বেশ কয়েকটি লাইন যেখানে রবীন্দ্রনাথ প্যারী সরকারের ফার্স বুক পড়ার কথা বলছেন৷ বাঙালি সমাজ বিস্মৃত যে একসময় বাঙালিকে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করেছিল প্যারীচরণ সরকারের ’’ফার্স বুক অফ ইংলিশ, সেকেন্ড বুক অফ ইংলিশ, থার্ড বুক অফ ইংলিশ, ফোর্থ বুক অফ ইংলিশ, ফিফথ বুক অফ ইংলিশ, সিক্সথ বুক অফ ইংলিশ’’ প্রাইমারগুলি৷ বইগুলো উচ্চ প্রশংসিত ছিল৷ ’’বর্ণপরিচয়’’ এর জন্ম তো ফার্স বুকের পাঁচ বছর পরে৷ বাঙালি ’’মাতৃভাষা মাতৃদুগ্দ’’ এই ভাবে জারিত হতে গিয়ে বিস্মৃতির অতলে ঠেলেছে প্যারীচরণ সরকারকে৷ এতটা বঞ্চনা কি তাঁর প্রাপ্য? আজ তাই ’’ফার্স বুক অফ ইংলিশ’’ ছাড়া কোন বইএর হদিশ পাওয়া যায় না৷

শুধু তাই নয়, কলকাতায় প্রথম ছাত্রাবাসের পরিকল্পনা তো প্যারীচরণেরই৷ দূর দূরান্তের ছাত্রদের কথা ভাবতেন৷ ইডেন হিন্দু হোস্টেলের প্রতিষ্ঠাতা তিনি৷ তিনি প্রেসিডেন্সির ইতিহাসে প্রথম বাঙালি ইংরেজির অধ্যাপক৷ অসম্ভব মেধাবী এই মানুষটি চোরবাগানে নিজের বাড়িতে গড়ে তুলেছিলেন ’’মদ্যপান নিবারণী সভা৷’’ সম্পাদনা করতেন ’’এডুকেশন গেজেট’’, ’’হিতসাধক’’ এবং ’’ওয়েল উইশার’’ পত্রিকা৷ যে কোন সামাজিক সংস্কারের একদম অগ্রভাগে থাকতেন এই মানুষটি৷ আজন্ম অভিন্নহৃদয় বন্ধু বিদ্যাসাগরের তিনি ডান হাত ছিলেন একপ্রকার৷ বিধবাবিবাহ, বহুবিবাহপ্রথা সবের বিরুদ্ধে একদম সামনে থেকে লড়াই করেছেন৷আদ্যন্ত বিনয়ী, সৎ মানুষটি যে অসাধারণ দানবীর ছিলেন সে কথা কি বাঙালি মনে রেখেছে? রাখেনি৷ তাঁকে বলা হত a man of unbound benevolence. ঐ সময়ে মাসে তিন চার হাজার টাকা আয় করতেন৷ গরীব ছাত্রদের লালন পালন করতেন, চিকিৎসা করাতেন, কত বিধবা মহিলা, পঙ্গু লোককে মাসোহারা দিতেন নিয়মিত৷ ঋণে জর্জরিত হয়ে যেতেন প্রায়৷ দান করতেন চুপিসাড়ে৷ তাঁর ডান হাতের দান, বাম হাত জানতো না৷ যেমন শিক্ষক হিসেবে ছিলেন জনপ্রিয়, তেমনি চর্চা করতেন হোমিওপ্যাথির৷ ভূগোলের ওপর বই লিখেছেন, বাচ্চাদের জন্য অ্যাটলাস বের করেছিলেন৷ ’’স্কুল বুক প্রেস’’ নামে ছাপাখানা স্থাপন করেছিলেন৷ ১৮৭৫ -এ অকালে চলে গিয়েছিলেন৷ না হলে আরও কিছু দৃষ্টান্তমূলক অবদান রেখে যেতেন৷ কিন্তু আজ তাঁর জন্মদ্বিশতবর্ষে (২৩ জানুয়ারি,১৮২৩---২৩ জানুয়ারি ২০২৩) এ প্যারীচরণ সরকার বিস্মৃতপ্রায়৷ তাঁর মানসকন্যা অর্থাৎ কলকাতায় তাঁর প্রতিষ্ঠিত বিদ্যায়তনটি প্যারীচরণ সরকার জন্মদ্বিশতবর্ষ উদযাপন কমিটির সাহায্যে গত বছর ২৩ জানুয়ারি সারা বাংলায় একমাত্র তাঁর জন্মদ্বিশতবর্ষের শুভ সূচনা করেছিল৷ না, সরকার কোন হাত বাড়িয়ে দেওয়ার প্রয়োজনবোধ তো করেইনি, সরকারি তরফেও সারা বছর কোন অনুষ্ঠান হয়নি৷ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে আশ্চর‌্যজনকভাবে নীরব থেকেছে প্রেসিডেন্সি, হেয়ার স্কুল, বারাসাত গভঃ স্কুল( প্যারীচরণ সরকার যেটির প্রতিষ্ঠাতা প্রধানশিক্ষক), বারাসাতে মেয়েদের স্কুলটি৷ আর সুধীসমাজ? সেখানে ঘুণ ধরেছে৷ দুঃখজনকভাবে চুপ থেকেছে কিছু সাহিত্য প্রতিষ্ঠান৷ ব্যর্থ নমস্কারটুকুও করার দরকার বোধ করেনি৷ কলকাতায় তাঁর প্রথম মূর্তি স্থাপিত হয়েছে ২০১৭তে তাঁর বিদ্যায়তনে)৷ শুধুমাত্র আশার আলো যে দ্বিশতবর্ষ কমিটির অনুরোধ মেনে পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ড আসন্ন আন্তর্জাতিক কলকাতা পুস্তক মেলায় একটি হল প্যারীচরণ সরকারের নামে উৎসর্গ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ ঘোর অন্ধকারের মাঝে একমাত্র আশার আলো৷ প্যারীচরণ সরকার জন্মদ্বিশতবর্ষ উদযাপন কমিটি এ জন্য কৃতজ্ঞতা জানায়৷ তারা যে কোন সাহায্য দরকারে গিল্ডকে করতে প্রস্তুত৷ কিন্তু প্রশ্ণ থেকে যায় উনিশ শতকের এই অসামান্য শিক্ষাবিদ, নারীশিক্ষার পথিকৃৎ এবং সমাজসংস্কারক কি সত্যিই এতখানি উপেক্ষার যোগ্য? আপনারাই এর বিচার করবেন৷ প্যারীচরণ সরকারের জন্মদ্বিশতবর্ষে তাঁকে আমাদের আভূমি প্রণাম৷   (সংগৃহীত)